বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযোদ্ধারা সফলভাবে রেলসেতু ধ্বংস করেছেন। কয়েক দিন পর একদিন খবর এল, পাকিস্তানি সেনারা সেই সেতু মেরামত শুরু করেছে। ভারতে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে সিদ্ধান্ত হলো, পাকিস্তানি সেনাদের ওই প্রচেষ্টা যেকোনো মূল্যে নস্যাত্ করতে হবে। তারপর শুরু হলো প্রস্তুতি।

এই অপারেশনের জন্য দলে অন্তর্ভুক্ত হলেন মো. মোজাম্মেল হকসহ ৩৫-৩৬ জন। তাঁদের নেতৃত্বে গোলাম হেলাল মোর্শেদ (বীর বিক্রম, তখন লেফটেন্যান্ট, পরে মেজর জেনারেল)। তাঁরা রওনা হলেন ভারত থেকে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালেন সেতুর দুই-আড়াই মাইল দূরে। এলাকাটির আশপাশ জঙ্গলাকীর্ণ।

মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারী অস্ত্র বলতে একটি মেশিনগান ও একটি তিন ইঞ্চি মর্টার। বাকি সব এলএমজি, এসএমজি ও রাইফেল। সকাল হওয়ার পর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলেন গন্তব্যস্থলে। জঙ্গল থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পেলেন বিহারি রেলকর্মীরা সেতু মেরামত করছে। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার সেখানে পাহারায় নিয়োজিত। তারা সবাই নিশ্চিন্ত মনে এবং কিছুটা শিথিল অবস্থায়।

অধিনায়ক নির্দেশ দেওয়ামাত্র মো. মোজাম্মেল হক ও তাঁর সহযোদ্ধাদের অস্ত্র একযোগে গর্জে উঠল। মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র থেকে তাঁরা প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করলেন। মুক্তিযোদ্ধারা দিনের বেলায় সেখানে আক্রমণ করবেন—পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও রেলকর্মীরা তা কল্পনাও করেনি। হতভম্ব সেনা ও রাজাকাররা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেশির ভাগ লুটিয়ে পড়ল। রেলকর্মীদেরও একই দশা হলো। রেলসেতু থেকে ভেসে আসতে থাকল আর্তচিত্কার। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা প্রতিরোধের কোনো সুযোগই পেল না। মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন শেষ হলো একতরফাভাবে, পাল্টা কোনো গোলাগুলির ঘটনা ছাড়াই। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগই পায়নি। আক্রমণে বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও রেলকর্মী নিহত এবং বাকিরা আহত হয়। এই অপারেশনে মো. মোজ্জাম্মেল হক যথেষ্ট দক্ষতা ও সাহসের পরিচয় দেন।

অপারেশন শেষে মুক্তিযোদ্ধারা চলে যান নিরাপদ স্থানে। এ ঘটনা ঘটে হরষপুরে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ ভাগে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত হরষপুর, জেলা সদর থেকে উত্তরে হবিগঞ্জ জেলার সীমান্তে। হরষপুরে আছে রেলস্টেশন। এর অল্প দক্ষিণে ছিল ওই রেলসেতু।

মো. মোজ্জাম্মেল হক চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে যুদ্ধ করেন ৩ নম্বর সেক্টরে। পরে এস ফোর্সের অধীনে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অংশ নেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান