বিজ্ঞাপন
default-image

আবুল কালাম ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। কুঠিবাড়িতে ছিল তাঁদের হেডকোয়ার্টার। ২৬ মার্চ খুব ভোরে তাঁরা ঢাকার খবর পেয়ে যান। সে সময় সেক্টর হেডকোয়ার্টারে বাঙালি কোনো কর্মকর্তা, এমনকি সেক্টরের সুবেদার মেজরও উপস্থিত ছিলেন না। ২৮ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কুঠিবাড়িতে গোলাবর্ষণ শুরু করে। হাবিলদার ভুলু মিয়ার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি অবস্থানে পাল্টা গোলাবর্ষণ করেন। ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁরা দিনাজপুর শহর শত্রুমুক্ত রাখতে সক্ষম হন। পরে পশ্চাদপসরণ করে ডালিমগাঁওয়ে অবস্থান নেন। সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ করেন। এসব যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর তাঁরা আশ্রয় নেন ভারতে।

ভারতে অবস্থানকালে আবুল কালামকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তাঁকে হেডকোয়ার্টার কোম্পানির মর্টার প্লাটুনের কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মে-জুনে তিনি দিনাজপুর এলাকায়, জুলাই-আগস্টে বাহাদুরাবাদ ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশন, সুগারমিলসহ রৌমারীর বেশ কয়েকটি স্থানের অপারেশনে অংশ নেন। সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি টেলিভিশন চ্যানেলের একটি দল রৌমারী আসে। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন রজার। দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ছবি চিত্রায়ণ করে। রৌমারীর হাজিরচরের একটি গোয়ালঘর থেকে কোদালকাটির পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থানে আবুল কালাম গোলাবর্ষণ করছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও তাঁদের অবস্থানে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করছিল। এতে এনবিসি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকেরা পর্যন্ত ভড়কে যান। কিন্তু আবুল কালাম বিচলিত না হয়ে পাকিস্তানি অবস্থানে মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করে চলেন। তাঁর এই সাহসিকতায় বিদেশি সাংবাদিকেরা পর্যন্ত বিস্মিত হন। পরে ওই প্রামাণ্যচিত্র বিশ্বব্যাপী প্রদর্শিত হয়। এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠে।

আবুল কালাম অক্টোবর থেকে সিলেট এলাকায় যুদ্ধ করেন। ছাতক, গোয়াইনঘাট, ছোটখেল, রাধানগর, সালুটিকর, গোবিন্দগঞ্জ, লামাকাজিঘাটসহ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। তিনি মর্টারের সাহায্যে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালাতেন।

মর্টার বাহিনীর কার্যকর ভূমিকার বিবরণ পাওয়া যায় এস আই এস নূরন্নবী খানের অপারেশন রাধানগর বইয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘৮ নভেম্বর, ১৯৭১। সকাল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা আমাদের লুনি গ্রামের সব কটি অবস্থানের ওপর মেশিনগানের অনবরত গুলি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করতে লাগল। এর মধ্যে আরআর (রিকোয়েললেস রাইফেল) গোলা ছিল মারাত্মক। আমরাও প্রস্তুত ছিলাম। আমাদের সম্মুখ অবস্থান থেকে পর্যাপ্তসংখ্যক দুই ইঞ্চি মর্টার গোলা ও এনারগা গ্রেনেড ছোড়া হলো। ক্লোজ ব্যাটেলে দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলা ও এনারগা গ্রেনেড খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বারবার হামলা, অনবরত মর্টার ও আরআর গোলা নিক্ষেপ করেও ওরা (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) আমাদেরকে অবস্থান থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণও সরাতে পারেনি।’

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান