বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ২০ মে। আনোয়ার হোসেন পাহাড়ীকে তাঁর মা বললেন, ‘বাবা, তুমি আমার একমাত্র ছেলেসন্তান। তার পরও বলি, বাড়িতে থেকে মরার চাইতে যুদ্ধ করে মরলেও আমি মনকে সান্ত্বনা দিতে পারব যে আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে।’ তারপর ২৪ মে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করেন তিনি।

১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানা আক্রমণ করে কাদেরিয়া বাহিনী। দুপুরে কয়েক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা যার যার অবস্থান থেকে একযোগে আক্রমণ শুরু করেন। এই যুদ্ধে অংশ নেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী।

থানার সামনে একটি কাঠের পুলের ২০ গজ দূরে কাঁচা সড়কের নিচে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিলেন তিনি। তাঁদের কাছে অস্ত্র ছিল তিনটি এলএমজি, নয়টি এসএমজি, দুটি মর্টার ও দুটি গ্রেনেড লঞ্চার। বাকি সব রাইফেল। পাহাড়ীর দলের ওপর দায়িত্ব ছিল থানার উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করার।

লাগাতার মর্টার, গ্রেনেড ও ব্লান্ডিসাইডের গোলার বিকট শব্দ ও অন্যান্য অস্ত্রের ঝনঝনানিতে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হতে থাকে। কয়েক মিনিট পর অন্য একটি দলের দলনেতা পাহাড়ীকে জানান, তাঁদের অবস্থানে দুটি বাংকার থেকে পাকিস্তানি সেনারা অবিরাম গুলিবর্ষণ করছে। গ্রেনেড লঞ্চার দিয়ে ওই বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপের জন্য তিনি পাহাড়ীকে অনুরোধ করেন।

আনোয়ার হোসেন পাহাড়ীর কাছে ছিল গ্রেনেড লঞ্চার। তিনি সেটা দিয়ে একটি বাংকারের ছিদ্রমুখ বরাবর গ্রেনেড ছোড়েন। সঠিক নিশানায় সেটি আঘাত হানে। স্তব্ধ হয়ে যায় সেখানকার এলএমজি। নিহত হয় বাংকারের ভেতরে থাকা পাকিস্তানি সেনারা।

এরপর তিনি একই পজিশন থেকে যখন দ্বিতীয় বাংকারে গ্রেনেড লঞ্চার দিয়ে গ্রেনেড ছুড়বেন, ঠিক তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। ট্রিগারে চাপ দেওয়ার পূর্বমুহূর্তে ওই বাংকারে থাকা শত্রুপক্ষের এলএমজিম্যান তাঁকে দেখে ফেলে। সে তড়িত্গতিতে এলএমজির ব্যারেলটি তাঁর দিকে ঘুরিয়ে গুলি শুরু করে। তাঁর মুখের বাঁ চোয়ালে এবং গলার বাঁ পাশে গুলি লাগে।

পাহাড়ীর পেছনে গ্রেনেড লঞ্চারের বাঁট ধরে ছিলেন সহযোদ্ধা হুমায়ুন বাঙ্গাল। তাঁরও পিঠে দুটি গুলি লাগে। দুজনই একসঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে অন্য সহযোদ্ধারা তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যান স্থানীয় গ্রাম্য চিকিত্সকের কাছে। বেঁচে যান তাঁরা।

আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী ১৯৭১ সালে সিরাজগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর তাঁকে একটি কোম্পানির সহকারী অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মধুপুর, ভেংগুলা, ভুঞাপুর, সিংগুলিয়া, সোহাগপাড়া, মির্জাপুরসহ আরও কয়েকটি জায়গায় সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান