‘তিনি সৈয়দপুর শহরে এসেছিলেন অবরুদ্ধ বাঙালিদের উদ্ধার করতে। তখন সকাল সাড়ে ১০টা। শুরু হয় তুমুল প্রতিরোধযুদ্ধ। এ সময় একটি তপ্ত বুলেট বিদ্ধ হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা মাহাতাব বেগের তলপেটে।’ কথাগুলো বলছিলেন সৈয়দপুরের প্রথম শহীদ মির্জা মাহাতাব বেগের দ্বিতীয় সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিন বেগ।
মাহাতাব বেগ ছিলেন লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। জন্ম দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার সাতনালা ইউনিয়নের জমিদার পরিবারে। বাবা আবদুল হামিদ বেগ ছিলেন জমিদার। মা মতিফুল বিবি। দিনাজপুরের দৈনিক উত্তরাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখতেন। ভালো অভিনয়ও করতেন। দিনাজপুরকেন্দ্রিক অনেক নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রানীর বন্দর বাজারে গড়ে তুলেছিলেন নজরুল পাঠাগার। এখানে নিয়মিত বসত সাহিত্যের আসর। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সাতনালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছয় ছেলে, সাত মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে ও দুই মেয়ে মারা গেছেন। নব্বইয়ের বেশি বয়সেও তাঁর স্ত্রী সালেহা বেগম সুস্থ, সচল রয়েছেন।
শহীদ মাহাতাব বেগের সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল। দেশ বিভাগের আগে ব্রিটিশ হোমগার্ডের সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া আনসার বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এসব তথ্য পাওয়া গেছে গবেষক অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমানের লেখা মুক্তিযুদ্ধে রঙ্গপুর গ্রন্থ থেকে।
সালাহউদ্দিন বেগ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর বাবা মাহাতাব বেগ নিজ গ্রাম সাতনালার শত শত মানুষকে প্রশিক্ষণ দেন। একসময় খবর পান, সৈয়দপুরের বাঙালিদের অবরুদ্ধ করে অবাঙালি আর পাকিস্তানি সেনারা চরম নির্যাতন, লুণ্ঠন চালাচ্ছে। এই অবরুদ্ধ বাঙালিদের উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
মাহাতাব বেগ কয়েক হাজার গ্রামবাসীকে নিয়ে ২৪ মার্চ সকাল আটটায় পায়ে হেঁটে সৈয়দপুর শহরের দিকে রওনা দেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন ছেলে এম এ রশিদ বেগ (২৮), সালাউদ্দিন বেগ (১৮) ও আবদুর রউফ (১৭)। খড়খড়িয়া সেতু পার হয়ে সৈয়দপুর শহরে ঢোকার মুখে পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ বাধে। একপর্যায়ে একটি বুলেট মাহাতাব বেগের তলপেটে বেঁধে। এরপর অবাঙালিরা তলোয়ার দিয়ে ছিন্ন করে মাহাতাব বেগের মাথা। ছিন্ন মস্তক হাতে নিয়ে তারা খোলা জিপে চেপে শহরে আনন্দ মিছিল করে।
স্বাধীনতার পর সৈয়দপুর শহরের জিআরপি চত্বরে শহীদ স্মরণে নির্মিত ‘স্মৃতি অম্লান’ সৌধের নামফলকে শহীদ মাহাতাব বেগের নাম উৎকীর্ণ রয়েছে। চিরিরবন্দর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত উপজেলার শহীদ স্মৃতিফলকেও তাঁর নাম রয়েছে। মাহাতাব বেগের স্মরণে সৈয়দপুরে গঠন করা হয়েছে ‘মাহাতাব বেগ স্মৃতি সংসদ’। সংসদের আহ্বায়ক আইনজীবী সুজাউদ্দৌলা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক শহীদদের সরকারি তালিকাতেও তাঁর নাম আছে। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও শহীদ মাহাতাব বেগকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা বা পদক দেওয়া হয়নি। আমরা সেই দাবি করে আসছি। আমাদের কাছে তিনি একজন বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা।’
সৈয়দপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার একরামুল হক বলেন, একজন বীর বাঙালির নাম হচ্ছে মাহাতাব বেগ। তাঁর তিন সন্তানও পরে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। শহীদ মাহাতাব বেগের আত্মদানের স্বীকৃতি হিসেবে সৈয়দপুর শহরে তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।
গ্রন্থনা: এম আর আলম, সৈয়দপুর, নীলফামারী