বিজ্ঞাপন
default-image

সৈয়দ রফিকুল ইসলাম চাকরি করতেন পাকিস্তানি বিমানবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দেওয়ায় তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। দেশে ফেরার জন্য তাঁর মন অস্থির হয়ে পড়ে। ১ ফেব্রুয়ারি ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ১৬ মার্চ ছুটি শেষ হলেও দেশের পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেন, চাকরিতে আর যোগ দেবেন না। এর কয়েক দিন পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ করেন ৩ নম্বর সেক্টর এলাকায়। জুলাই মাসে তিনি তাঁর দলের সঙ্গে ছিলেন নরসিংদীর বেলাবতে। তাঁর দলনেতা ছিলেন সুবেদার আবুল বশর।

১৩ জুলাই সৈয়দ রফিকুল ইসলাম ও তাঁর সঙ্গীরা খবর পান, নরসিংদী থেকে একদল পাকিস্তানি সেনা নদীপথে বেলাব আসছে। দলনেতা আবুল বশরের নেতৃত্বে তাঁরা বানার নদীর পশ্চিম পাড়ে টোক গ্রামের কাছে অ্যামবুশ করেন। তাঁদের কাছে অস্ত্র বলতে ছিল দুটি মেশিনগান, দুটি লাইট মেশিনগান, চারটি স্টেনগান, পাঁচটি রাইফেল, ১৫টি এসএলআর ও একটি রকেট লাঞ্চার। সেনা, ইপিআর ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা মিলে তাঁরা ছিলেন মোট ৪০ জন।

রাতভর তাঁরা লঞ্চের অপেক্ষায় বসে থাকেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লঞ্চ রাতে আসেনি। সকালে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা নিরাশ হলেও অবস্থান ত্যাগ করেননি। ওই এলাকায় ছিল কিছু পাকিস্তানি দোসর। তারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নেওয়ার খবর গোপনে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে পৌঁছে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আকস্মিক আক্রমণের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হয়। সাধারণত লঞ্চযোগে তারা যাতায়াত করত। ১৪ জুলাই তারা লঞ্চ ছাড়াও দেশি নৌকায় করে আসে। লঞ্চ ছিল অনেক পেছনে। দেশি নৌকাগুলো যখন অ্যামবুশ এলাকা পার হচ্ছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধারা সন্দেহ করেনি। নৌকাযোগে আসা পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। একটি ছইওয়ালা নৌকার গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় মমতাজ নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা সেই নৌকা থামার নির্দেশ দেন। এর মধ্যে সেখানে লঞ্চও এসে উপস্থিত হয়। পাকিস্তানি সেনারা গুলি শুরু করে। মমতাজ সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলোও গর্জে ওঠে।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যান। তাঁদের আরেকটি বিপর্যয় হয়। রকেট লাঞ্চার বিকল হয়ে যাওয়ায় তাঁরা রকেট ছুড়তে পারেননি। এর পরও বিচলিত না হয়ে তাঁরা সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করেন। তারপর পশ্চাদপসরণ করেন। সেদিন যুদ্ধে তাঁদের দলনেতা আবুল বশর, সহযোদ্ধা বারিক, সোহরাব হোসেন, নূরুল হক, মমতাজসহ আরও কয়েকজন শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে বিয়ে করেছিলেন। তাঁকে সৈয়দ রফিকুল ইসলামই মুক্তিযুদ্ধে আনেন। নূরুল হকের শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে তাঁর স্ত্রী তত্ক্ষণাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান