বিজ্ঞাপন
default-image

মো. হেলালুজ্জামান ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের সদর দপ্তরের প্রকৌশল শাখায় কর্মরত ছিলেন। মার্চের প্রথম দিকে হেলালুজ্জামানসহ কয়েকজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ শোনার জন্য কর্মস্থলে প্রচারণা চালান। এ জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের কালো তালিকাভুক্ত করে। বিষয়টি জানতে পেরে তিনি কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যান। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ রাতে তিনি নারায়ণগঞ্জে ছিলেন। পরে সেখান থেকে পালিয়ে নিজ এলাকা নেত্রকোনা হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেষখোলায় যান। কিছুদিন পর সেখানে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম শুরু হলে তিনি এতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১১ নম্বর সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন।

জামালপুর জেলা ছিল মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টরের আওতায়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জামালপুরের কামালপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি বড় ঘাঁটি। এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয়। সাব-সেক্টর কমান্ডার আবু তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল ১৫ আগস্ট ভোরে কামালপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। মো. হেলালুজ্জামান ছিলেন একটি দলের নেতৃত্বে। তাঁদের কাছে অস্ত্র বলতে ছিল এসএমজি, স্টেনগান ও রাইফেল।

যথাসময়ে তাঁরা আক্রমণ শুরু করেন। হেলালুজ্জামানের ওপর দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৫ নম্বর বাংকারে আক্রমণ করার। এই বাংকার ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থানে। হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে আক্রমণের পর তাঁদের সবার সেখান থেকে সরে পড়ার কথা ছিল। অন্যান্য দল নিরাপদে পেছনে সরে গেলেও হেলালুজ্জামানের দলটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর বেশ কিছু গ্রেনেড ছোড়েন। গ্রেনেড বিস্ফোরণে বেশ কজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য দল এগিয়ে এসে পাল্টা আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে তাদের মূল ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। সেদিনের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৫-১৬ জন নিহত হয়। আহত হন মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন।

হেলালুজ্জামান পরে আরও কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। ১৪-১৫ নভেম্বর কামালপুরে সেক্টর কমান্ডার আবু তাহেরের নেতৃত্বে কামালপুরে এক বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে হেলালুজ্জামান ছিলেন একটি দলের নেতৃত্বে। সেদিন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও তাঁরা ব্যর্থ হন। ১৫ নভেম্বর সকালে বিজয় নিশ্চিত ভেবে সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের নিরাপদ অবস্থান ছেড়ে যুদ্ধক্ষেত্রের ভেতরে চলে আসেন। তখন তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। সে সময় মো. হেলালুজ্জামান তাঁর কাছেই ছিলেন। সকাল নয়টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি শেল সেখানে এসে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। শেলের একটি টুকরা আবু তাহেরের একটি পায়ে আঘাত করে। তাঁর পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। মুক্তিযোদ্ধাদের এই আক্রমণ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। আহত মেজর আবু তাহেরকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য দ্রুত ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান