দুপুর থেকে শুরু হয়ে যায় প্রচণ্ড যুদ্ধ। মো. আবু তাহের ও তাঁর সহযোদ্ধারা আক্রমণ চালান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছাতকের প্রতিরক্ষা অবস্থানে। সুরমা নদীর তীরে ছাতক।
প্রথমে মুক্তিবাহিনীর আলফা দল ১৪ অক্টোবর দুপুরের আগেই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির এক-দেড় শ গজের মধ্যে পৌঁছায়। তাদের রিকোয়েললেস রাইফেলের (আর আর) গোলায় পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয়ে যায়। সন্ধ্যার আগেই এই দল ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
মো. আবু তাহের ও তাঁর সহযোদ্ধারা ছিলেন একটু পেছনে। এ সময় তাঁরা এগিয়ে আলফা দলের কাছাকাছি অবস্থান নেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। পরদিন (১৫ অক্টোবর) পাকিস্তানি তিনটি হেলিকপ্টার থেকে তাঁদের ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করা হতে থাকে। কিন্তু তার পরও তাঁরা বিচলিত বা মনোবল হারাননি। আবু তাহের ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেন।
১৫ অক্টোবর সারা দিন যুদ্ধ চলে। ১৬ অক্টোবর সকালে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। আলফা দল সামনে থাকে। আবু তাহের ও তাঁর সহযোদ্ধারা পেছন থেকে ফায়ার সাপোর্ট দেন। সন্ধ্যার মধ্যেই গোটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকেই যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ মুক্তিযোদ্ধাদের আয়ত্তের বাইরে যেতে থাকে। কারণ, সিলেট থেকে ছাতকে আক্রান্ত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সাহায্য (রিইনফোর্সমেন্ট) চলে আসে। তারা দোয়ারা বাজার বেড়িবাঁধ দিয়ে ছাতকের দিকে অগ্রসর হয়। নতুন এই পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের পেছনের উঁচু টিলাগুলোতে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়।
ফলে মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন। নতুন এই পাকিস্তানি সেনাদের আগমন ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। কারণ, পেছনে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কাট অফ পার্টি। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য আসা সাহায্য প্রতিহত করা। তিন দিন স্থায়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ছাতকে প্রায় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের ছাতক থেকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়।
মো. আবু তাহের ইপিআরে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে তিনি সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে তিনি ভারতে যান। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হন। শেরপুর জেলার নকশী বিওপির যুদ্ধ, বৃহত্তর সিলেট জেলার টেংরাটিলা ও সালুটিকরসহ বিভিন্ন স্থানে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান