১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলেও ঢাকা শহরের একটি অংশ (মিরপুর) তাদের সহযোগী অবাঙালিদের (বিহারি) দখলে থেকে যায়। এভাবে কেটে গেল আরও প্রায় দেড় মাস। অবাঙালিরা আত্মসমর্পণ করল না। এরপর সরকার সেখানে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের অভিযান চালানোর নির্দেশ দিল। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে আক্রমণ চালানোর আগে অবাঙালিদের আবারও আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা আত্মসমর্পণ করার বদলে আকস্মিক আক্রমণ চালাল মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। শুরু হলো ভয়াবহ যুদ্ধ। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হলেও অবাঙালিদের হাতে শহীদ হলেন লেফটেন্যান্ট সেলিম, মো. আবদুল মমিনসহ প্রায় দেড় শ জন মুক্তিযোদ্ধা।
মিরপুর ছিল অবাঙালি-অধ্যুষিত এলাকা। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে মিত্রবাহিনীর ১০ বিহার রেজিমেন্ট মিরপুরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকে। সেখানে বিপুলসংখ্যক অস্ত্রধারী অবাঙালি আত্মগোপন করে ছিল। ৩০ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধারা (দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুলিশ) মিরপুরে অভিযান শুরু করেন। তাঁরা সেখানে যাওয়ামাত্র প্রচণ্ড আক্রমণের সম্মুখীন হন।
মো. আবদুল মমিন চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে। তখন তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। মো. আবদুল মমিন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মেজর কে এম সফিউল্লাহর (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান) নেতৃত্বে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহে গিয়ে তিনি অন্যদের সঙ্গে মিলিত হন এবং সাহসের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। পরে যুদ্ধ করেন ৩ নম্বর সেক্টর এবং এস ফোর্সের অধীনে।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে আখাউড়া যুদ্ধে মো. আবদুল মমিন যথেষ্ট সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন। ৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আখাউড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল অংশ নেয়। মো. আবদুল মমিনের দল আখাউড়ার উত্তর দিকে সিঙ্গারবিল হয়ে অগ্রসর হয়। সিঙ্গারবিলের আশপাশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সিঙ্গারবিল জেটি ও পার্শ্ববর্তী রাজাপুর দখল করে নেন। এরপর তাঁরা আজমপুর রেলস্টেশনে আক্রমণ চালান।
মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি দল ১ ডিসেম্বর দুপুরে আজমপুর রেলস্টেশন দখল করলেও পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা আক্রমণ করে কয়েক ঘণ্টা পর স্টেশনটি পুনর্দখল করে নেয়। তখন এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ আজমপুর রেলস্টেশন পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেন। এরপর মো. আবদুল মমিনের দল সেখানে আক্রমণ চালায়।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান