বিজ্ঞাপন
default-image

ওয়াজেদ আলী মিয়া বারকিসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতের অন্ধকারে ভারত থেকে ঢোকেন বাংলাদেশের ভেতরে। কয়েক মাইল হেঁটে পৌঁছান নির্জন রেললাইনের ধারে। সেখানে আশপাশে জনবসতি নেই। দ্রুত রেললাইনের নিচে অ্যান্টি ট্যাংক মাইন পুঁতে বৈদ্যুতিক তার লাগিয়ে তা টেনে নিলেন প্রায় ৩০০ গজ দূরে। দেড়-দুই ঘণ্টার মধ্যেই কাজ শেষ। তারপর ভোরের আলো ফুটে উঠল। কয়েক ঘণ্টা পর শোনা গেল ইঞ্জিন টানা ট্রেনের শব্দ। ইঞ্জিনটি ধীরগতিতে চিহ্নিত স্থান অতিক্রম করামাত্র রিমোট কন্ট্রোলের সুইচ টিপে বিস্ফোরণ ঘটালেন মুক্তিযোদ্ধারা। একই সময় গর্জে উঠল তাঁদের প্রত্যেকের হাতের অস্ত্র। মুকুন্দপুরে এ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে।

মুকুন্দপুর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার অন্তর্গত। মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায় মুকুন্দপুরে ট্রেনের ইঞ্জিন ও কয়েকটি বগি ধ্বংস করেন। তাঁরা খবর পেয়েছিলেন, সেদিন ট্রেনে একদল পাকিস্তানি সেনা থাকবে। এ খবর পেয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা মুকুন্দপুরে সেই ট্রেন অ্যামবুশ করেন। এই দলে ছিলেন ওয়াজেদ আলী মিয়া। তিনি ছিলেন বিস্ফোরক দলের প্লাটুন কমান্ডার। মাইন লাগানোর পর এর সঙ্গে বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ ঘটিয়ে তা টেনে নেওয়া হয় ৩০০ গজ দূরে। সেখানে ছিল রিমোট কন্ট্রোল। এ পদ্ধতি তাঁরা আগে প্রয়োগ করেননি। সেদিনই প্রথম প্রয়োগ করেন।

ওই দিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রায় এক কোম্পানি সেনা আখাউড়া থেকে মুকুন্দপুর হয়ে হরষপুর যাচ্ছিল। মাইন বিস্ফোরণে ট্রেনের ইঞ্জিন ও কয়েকটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুজন কর্মকর্তাসহ প্রায় ২৭ জন সেনা নিহত হয়। এ ঘটনার দিন কয়েক পর মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান, বিধ্বস্ত ইঞ্জিন এবং ক্ষতিগ্রস্ত বগি ও ওয়াগন সরিয়ে নেওয়ার জন্য সেখানে একটি ক্রেন নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা অপেক্ষা করছে। এ খবর পেয়ে ওয়াজেদ আলী মিয়া ও তাঁর সহযোদ্ধারা ১৯ সেপ্টেম্বর আবার তিনটি রকেট নিয়ে সেখানে যান। কিন্তু তখন ক্রেনটি সেখানে ছিল না। বিধ্বস্ত ইঞ্জিন ও ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াগন রেললাইনে দাঁড় করানো ছিল। পাশে একদল পাকিস্তানি সেনাকে প্রহরারত অবস্থায় দেখা যায়। ওয়াজেদ আলী মিয়া মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে দুজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সাহসের সঙ্গে ইঞ্জিনের ২৫ গজের মধ্যে গিয়ে রকেটের সাহায্যে ইঞ্জিনটি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেন। নির্ভুল নিশানায় ইঞ্জিনের মাঝবরাবর রকেট বিস্ফোরিত হয়।

ওয়াজেদ আলী মিয়া চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে চাকরিরত ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে যুদ্ধ করেন ৩ নম্বর সেক্টরের কলকলিয়া/বামুটিয়া সাব-সেক্টরে, পরে এস ফোর্সের অধীনে। একটি যুদ্ধে তিনি সামান্য আহত হন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান