বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আবদুল জব্বার খান ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে বারবার ঝটিকা আক্রমণ চালায়। তাঁরা সেই আক্রমণ প্রতিবারই প্রতিহত করেন। যুদ্ধ চলতে থাকে। পরদিন শুরু হয় তাঁদের ওপর বিমান থেকে আক্রমণ। এই আক্রমণেও তাঁরা বিচলিত হলেন না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের নভেম্বরের প্রথমার্ধের। ঘটেছিল বিলোনিয়ায়।

ফেনী জেলার অন্তর্গত বিলোনিয়া। প্রায় ২৬ কিলোমিটার লম্বা ও ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এই এলাকার একদিকে ভারতের ভূখণ্ড। উপদ্বীপের মতো দেখতে এই এলাকা লম্বালম্বি ভারতের ভেতরে প্রবেশ করেছে। মুহুরী নদী বিলোনিয়ার ভেতর দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত। ১৯৭১ সালে বিলোনিয়া এলাকায় ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি শক্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ। সেখানে নিয়োজিত ছিল তাদের ১৫ বালুচ রেজিমেন্টের পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়ন। আরও ছিল ইপিসিএএফ, পাকিস্তানি পুলিশ ও স্থানীয় রাজাকার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিলোনিয়া এলাকা ২২ জুন পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। এরপর ওই এলাকা পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিলোনিয়া মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল বিলোনিয়ার তিন দিকে অবস্থান নেয়।

আক্রমণের নির্ধারিত তারিখ ছিল ২ নভেম্বর। ৩১ অক্টোবর থেকে সেখানে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। এর মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা বিলোনিয়ার তিন দিকে অবস্থান নেন। বৃষ্টির জন্য আক্রমণের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনারা ৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পায়নি। পরে উপস্থিতি টের পেয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর একযোগে আক্রমণ শুরু করে। আবদুল জব্বার খান ও তাঁর দল ছিল সালিয়ায়। তিনি ছিলেন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানিতে। বিলোনিয়া আক্রমণে ২ নম্বর সেক্টরের রাজনগর সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কে ফোর্সের অধীন দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ এস ফোর্সের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একাংশ এবং ১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারাও অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধারা বিলোনিয়ার উত্তরাংশে চন্দনা, সালিয়া ও গুতুমা পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পালিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, আবদুল জব্বার খান ও তাঁর দল (দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি) মুহুরী নদীর পূর্ব তীরে ধনীকুণ্ড এলাকা দিয়ে বিলোনিয়ায় প্রবেশ করে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিমমুখী প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। মূল আক্রমণকারী দলের বাঁ দিক সুরক্ষিত রাখাই ছিল এর উদ্দেশ্য। চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর হতভম্ব পাকিস্তানি সেনারা পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সবদিকেই মুক্তিযোদ্ধারা থাকায় তাদের ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফাঁদে আটকে পড়া পাকিস্তানি সেনাদের উদ্ধারে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর চারটি এফ-৮৬ স্যাবর জঙ্গিবিমান মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ চালায়। আবদুল জব্বার খানসহ মুক্তিযোদ্ধারা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সাহস ও বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। তাঁদের ভারী মেশিনগান পাকিস্তানি বিমান হামলায় সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়। শহীদ ও আহত হন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। আবদুল জব্বার খান নিজেও সেদিন গুলিতে আহত হন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৭ নভেম্বর বিলোনিয়া মুক্ত হয়।

আবদুল জব্বার খান চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টর, পরে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। মাধবপুর, মুকুন্দপুরসহ বিলোনিয়ার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান