বিজ্ঞাপন
default-image

যেকোনো যুদ্ধ, যত নৈতিক বা অনৈতিক হোক না কেন, যুদ্ধরত সৈনিকদের দাঁড় করিয়ে দেয় মৃত্যুর দুয়ারে। এটা বাস্তব যে, যুদ্ধে সবাই মরে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, ১৫ হাজার উড়ন্ত গুলির মাত্র ১৫ শতাংশ অপর পক্ষের সৈন্যদের গায়ে লাগে। এই ১৫ শতাংশের মাত্র পাঁচজন মারা যায়। বাকিরা আহত হয়। এই হতাহতের অনু যতই কম হোক, যুদ্ধের মুহূর্তটি থাকে অনিশ্চয়তায় ভরা, সবচেয়ে বেশি থাকে শত্রুর ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে। দেখা গেছে, আক্রমণে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কেউ মনোযোগ দিয়ে কোরআন শরিফ পড়ছে, কেউ গাছের নিচে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে চোখের পানি ফেলে দীর্ঘ মোনাজাত করছে। কেউ সহযোদ্ধাদের কাছে জীবনের শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করছে, তার মাকে যেন দেখে, শিশুসন্তানদের দায়িত্ব যেন নেয়। এমনও দেখেছি, প্রিয়তমার কাছে গভীর মনোযোগের সঙ্গে চিঠি লিখছে যোদ্ধা, যদিও সে জানে, যুদ্ধের মাঠ থেকে চিঠি ডাকে দেওয়া যাবে না। কোনো কিশোরযোদ্ধা আবেগভরে চিঠি লিখছে মা-বাবার কাছে। ‘যদি না ফিরি’, শেষ কথাটি বলে যাওয়ার শেষ প্রয়াস।

১.

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সোজা ১২-১৩ কিলোমিটার পূর্বে সীমান্তের কাছে ধর্মগড়। মারফতি গান চান মিয়ার খুব প্রিয়। মনোযোগের সঙ্গে কিছু করলে তার মুখে থাকতেই হবে মারফতি গান। ধর্মগড় দখলের যুদ্ধের প্রাক্কালে আমাদের চান মিয়া তার এলএমজি খুলে ব্রিজ ব্লক আর রিকয়েললেস স্প্রিং মনোযোগের সঙ্গে বারবার পরিষ্কার করছে আর গুনগুনিয়ে গাইছে: ‘কে তোমার আর যাবে সাথে/কোথায় রবে ভাই-বন্ধুগণ/পড়বি যেদিন কালের হাতে/কে তোমার আর যাবে সাথে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গেরস্তের কামলা চান মিয়া যোগ দিয়েছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। যুদ্ধ, চান মিয়া আর বীরত্ব ছিল সমার্থক। যুদ্ধ শেষ হলে চান মিয়াও হারিয়ে গেছে সেই আমনজতার মধ্যে।

২.

পাঁচ নম্বরের একটি সাব-সেক্টর বারসোরা। সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর মোঃ মোসলেমউদ্দিন। তিনি সাব-সেক্টরের সাঙ্কেতিক নাম দিয়েছেন ‘ব্লু শার্টস’।

সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ থানার সাচনায় পাকিস্তানিদের শক্ত অবস্থান। কেবল বারসোরা সাব-সেক্টরেই নয়, গোটা পাঁচ নম্বর সেক্টরের প্রায় সবাই ছিল গণযোদ্ধা, গাঁ-গেরামের খেটে খাওয়া মানুষ, ছাত্রজনতা। যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতার নেই তাদের কাছে। সামান্য প্রশিক্ষণ আছে কয়েকজনের, তাও কয়েক সপ্তাহের। বাকিরা যুদ্ধ করেই যুদ্ধ শিখেছে। অতীতে সাচনা দখল করার চেষ্টা করা হয় দুইবার। সম্ভব হয়নি। তৃতীয়বার ৮ আগস্ট চূড়ান্ত আক্রমণ পরিকল্পনা করা হয়। মোঃ শিরাজুল ইসলাম এ আক্রমণের একজন গণযোদ্ধা।

শিরাজুল ইসলাম সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। সহযোদ্ধারা তাকে একজন সাহসী যোদ্ধা হিসেবেই জানে। বিভিন্ন যুদ্ধে তার কৃত্য আর ঋজুতা তাকে এ পরিচিতি দিয়েছে।

default-image

৮ আগস্টের আক্রমণ সফল হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। সাচনায় পাকিস্তানি অবস্থান দখল করা সম্ভব হয়। এ আক্রমণের নেতৃত্ব দেয় শিরাজুল। ৩০ জুলাই শিরাজুল একটি চিঠি লেখে তার বাবার কাছে। সাচনার শত্রুর অবস্থান দখল করে শিরাজুল ফেরেনি। নেতৃত্ব দিয়ে শাহাদত্ বরণ করে সে। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে মোঃ শিরাজুল ইসলামের বাবা শিরাজুলের লেখা চিঠিটি নিয়ে আসেন মেজর মোসলেমউদ্দিনের কাছে। মেজর মোসলেমউদ্দিন শহীদ শিরাজুলের প্রত্যয়দীপ্ত ও আবেগময় চিঠিটি বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের পড়ে শোনাতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের শিরায় তখন প্রবাহিত হতো দেশের জন্য প্রাণ উত্সর্গ করার স্পৃহা। ভিন্ন চিঠিতে তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফকে শিরাজুলের চিঠির অনুলিপি দিয়ে চিঠিটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পড়ে শোনানোর অনুরোধ জানান।

শহীদ মোঃ শিরাজুল ইসলামের চিঠি

টেকেরঘাট হইতে

তারিখ ৩০-৭-৭১ ইং

প্রিয় আব্বাজান,

আমার ছালাম নিবেন। আশা করি খোদার কৃপায় ভালই আছেন। বাড়ীর সকলেরই কাছে আমার শ্রেণীমত ছালাম ও স্নেহ রইল। বর্তমানে যুদ্ধে আছি। আলী, রাজা, রওশন, মাত্তাব, রেনু, ইব্রাহীম, ফুলমিয়া সকলেই একত্রে আছি। জীবনকে তুচ্ছ মনে করি, কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে জীবনের কোন মূল্য থাকবে না। তাই যুদ্ধই জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে। চাচা, মামাদের ও বড় ভাইদের নিকট আমার ছালাম। বড় ভাইকে চাকুরীতে যোগদান দিতে নিষেধ করবেন। জীবনের চেয়ে চাকুরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাক্ব। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।

আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারণ নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সকল সাধ মিটে যাবে।

দেশবাসী স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর। মির্জ্জাফরী করিও না। কারণ মুক্তি ফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবে না এবং বাংলায় তোমাদের জায়গা দিবে না।

ছালাম, দেশবাসী ছালাম।

ইতি

মোঃ শিরাজুল ইসলাম

তিন.

৩০ জুলাই রাত ৩ টা ৩০ মিনিটে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের দুই কোম্পানি ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে আক্রমণ করে কামালপুরের পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষাদুর্গ। আক্রমণকারী যোদ্ধাদের প্রায় ৮০ ভাগই ছিল সদ্য ভর্তি করা সাধারণ গ্রামের ছেলে। মাত্র ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা শত্রু-অবস্থান প্রায় দখল করে ফেলে। সালাউদ্দিন পৌঁছে যায় শত্রুর বাঙ্কারের কাছে। ঠিক তখনই শত্রুর গোলা আঘাত করে তাকে। সহযোদ্ধারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার কাছে দৌড়ে আসে। বলে, স্যার কলেমা পড়েন। মৃত্যুঞ্জয়ী যোদ্ধা উত্তর দেন, আমার কলেমা আমি পড়ব, খোদার কসম, তোরা কেউ পিছু হটবি না। তারপর বিড়বিড় করে স্তিমিত স্বরে বলতে থাকেন, মরতে হয় শত্রুদের মেরে মর, বাংলাদেশের মাটিতে মর। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের নিথর দেহ আনতে গিয়ে প্রাণ দেয় সিপাই হায়াত আলি ও সিপাই সিরাজুল ইসলাম। শত্রুর বাঙ্কারের সামনে থেকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের মৃতদেহ আনা আর সম্ভব হয়নি।

২১ জুলাই ২০০৫, বৃহস্পতিবার। মেজর জেনারেল কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লার বাসায় গেছি মুক্তিযুদ্ধের অপ্রকাশিত কিছু তথ্য নিয়ে আলাপ করতে। জেনারেল সফিউল্লা মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত তিনটি ব্রিগেডের (এস ফোর্স, জেড ফোর্স এবং কে ফোর্স) একমাত্র জীবিত ব্রিগেড কমান্ডার। কথায় কথায় বললাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য কামালপুর যুদ্ধের ওপর একটি ডকু-ফিচার ছবি বানিয়েছি। তিনি বললেন, সালাউদ্দিনকে দেখিয়েছ? আমি বললাম, স্যার, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ কামালপুর যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাকে ছাড়া তো কামালপুর যুদ্ধের কোনো ছবিই হয় না। আমাদের সব সাধ্য দিয়ে ওনার সাহস, বীরত্ব ও আত্মত্যাগকে দেখানোর চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে তার গৌরবদীপ্ত মৃত্যুদৃশ্য। আমি প্রশ্ন করলাম, আপনি সালাউদ্দিনকে চেনেন কীভাবে? ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আর আপনি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের। মনে হয় চাকরিও করেননি তিনি আপনার সঙ্গে। যুদ্ধের সময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কোলকাতায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সদর দপ্তরে যোগ দেন ৩ জুলাই। আর আপনি তখন সিলেট এলাকায় তিন নম্বর সেক্টর কমান্ড করছেন।

জেনারেল সফিউল্লাহ হঠাত্ নীরব হয়ে গেলেন। স্বাভাবিক আলোচনার আনন্দঘন পরিবেশ মিলিয়ে গেল। মিনিট খানেক পর মুখ খুললেন তিনি। ’৭০ সালে কোয়েটায় সালাউদ্দিন যখন স্কুল অব ইনফ্যান্টি অ্যান্ড ট্যাকটিকসে জুনিয়র টেকনিক্যাল কোর্স (জেটিসি) করছিল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে, তখন থেকেই আমি ওকে জানতাম। জুলাইয়ের ১২ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত কলকাতায় সশস্ত্র বাহিনী সদর দপ্তরে আমাদের সিনিয় অফিসারদের একটি মিটিং ছিল। সালাউদ্দিন তখন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসে ওখানে। অপেক্ষা করছিল পোস্টিংয়ের জন্য। দুই দিন দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয় ওর সঙ্গে। দু দিনের আলাপেই আমি ওর দেশপ্রেম এবং পেশাগত জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে যাই। আমি মনে ও মুখে ওর সাফল্য কামনা করি। আমরা কলকাতায় থাকতেই সালাউদ্দিন চলে যায় মেঘালয়ের তেলঢালায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। আমি চলে যাই সেক্টরে। আগস্টের ১ বা ২ তারিখে শুনলাম ৩১ জুলাই ভোরে সালাউদ্দিন কামালপুর যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। যুদ্ধে সৈন্যরা মারা যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সালাউদ্দিনের মৃত্যু কোনোভাবেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না।

তিনি বলছিলেন, নভেম্বরের ১৭ তারিখ। শবে কদর। একবারে সেহরি খেয়ে একটু রাত করে ঘুমিয়েছি। শেষ রাতে একটি দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নে দেখছি, আমি একটা চৌকিতে চোখ খুলে চিত হয়ে শুয়ে আছি। আমার মাথা যেদিকে তার বিপরীত দিকে ঘরের দরজা। হঠাত্ দেখি, মলিন চেহারা নিয়ে অতি ধীর পায়ে সালাউদ্দিন ঢুকছে। আমি অবাক। তাহলে কি কামালপুরের যুদ্ধে ও মারা যায়নি? এরই মধ্যে এক পা-দুই পা করে এগিয়ে সালাউদ্দিন পাশে এসে দাঁড়াল। আমাকে বলল, স্যার একটু সরেন, আমি শোব। পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে বলল, স্যার দেখলেন, আমাকে না নিয়েই সবাই চলে এল, আমাকে কেউ আনল না। একটু বিরতি দিয়ে আবারও বলল, স্যার, দেখলেন, আমাকে না নিয়েই সবাই চলে এল।

default-image

প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অক্টোবরের ১০ তারিখ মেঘালয়ের তেলঢালা থেকে সিলেটের বিপরীত দিকে আসামের আমবাসায় পৌঁছেছে। জেনারেল শফিউল্লার ঘুম ভেঙে যায়। চোখে পানি। ভোর হতেই তিনি হেজামুরায় তার সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে গাড়ি নিয়ে চলে যান প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আমবাসায়। অধিনায়ক মেজর জিয়াউদ্দিনকে না পেয়ে ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারীকে স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনিয়ে অনুরোধ করেন, একটি মিলাদ দিয়ে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতে।

কোয়েটায় কোর্স করার সময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শেষ চিঠি লেখেন তার মায়ের কাছে।

ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের চিঠি

Capt. Salauddin Momtaz

School of infantry And Tactics

JTC-6 'A' MESS

Quetta

8.3.70

শ্রদ্ধেয় আম্মাজান,

আমার ছালাম নিবেন। আমি কোয়েটাতে আছি একটা Course (কোর্স) করছি। আপনাকে অনেক দিন পত্র লিখি নাই। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ভাল আছি। আমার জন্য আল্লার কাছে দোয়া করবেন, যেন আমি কোর্সে First আসতে পারি। দূরে আসলে আপনাকে যে কত মনে পড়ে তা একমাত্র খোদা জানে। আমি আপনার অধম সন্তান, আপনাকে আজ পর্যন্ত দুটো কথা দিয়েও সন্তুষ্ট করতে পারি নাই। তারেক, নাজমু, জুলেখা, কামরুন ও সোহেলাকে আমার দোয়া জানাবেন। ডলু ও নুনুর Addressটা জানাবেন। আমি ভাল আছি, দোয়া করবেন।

ইতি আপনার

বাবর

৪.

দুই নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আগে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ শপথ গ্রহণ করাতেন প্রত্যেকের হাতে এক মুঠ মাটি দিয়ে। এ মাটি বাংলাদেশ থেকে আনা মাতৃভূমির মাটি। তিনি বলতেন, তোমাদের হাতে বাংলাদেশের শুধু এক মুঠ মাটি। আমাদের দরকার গোটা বাংলাদেশের মাটি। ছেলেরা দেশপ্রেমের এক প্রগাঢ় মমতায় আরো প্রত্যয়ী হয়ে উঠত। এই মেজর খালেদই যোদ্ধাদের বলতেন, আমি তোমাদের দেশপ্রেম শেখাব না। দেশপ্রেম তোমাদের এমনিতেই আছে, তা না হলে তোমরা এখানে আসতে না। আমার কাজ তোমাদের যুদ্ধ শেখানো। মেজর খালেদ মোশাররফ ছিলেন যুদ্ধ-উদ্দীপনা জাগানোর এক জাদুকর। তার কথায় ও কাজে মোহবিষ্ট হয়ে যেত ছেলেরা। মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে বলতেন, যেভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে সৈনিক তৈরি করতে হয় সে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় ও সুযোগ আমার নেই। যুদ্ধের মাঠই তোমাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি। যুদ্ধ করেই তোমাদের যুদ্ধ শিখতে হবে। সামান্য প্রশিক্ষণ এবং কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই যুদ্ধ করেছে আমাদের ছেলেরা। যুদ্ধ করেছে মাতৃভূমির প্রতি অপার ভালবাসায়। যুদ্ধে ভুল করেই যুদ্ধ শিখেছে আমাদের তারা। কখনো মারাত্মক ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে প্রাণ দিয়ে।

একাত্তরে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার বামনী বাজারের দক্ষিণে বেড়ি বাঁধের ওপর এক ভুল করা যুদ্ধে জড়িয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধারা। প্রয়োজনীয় রেকি না করেই তারা তাদের ক্যাম্প স্থানান্তর করতে যায় কাচারীহাট। পাকিস্তানিরা পাকবাজার (এখন বাংলাবাজার) এবং বামনীবাজার দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। কমান্ডার আবদুর রাজ্জাকের তখন ১০৫ ডিগ্রি জ্বর। কমান্ড করছিল তার উপ-অধিনায়ক সালেহ আহমেদ মজুমদার। মুুক্তিযোদ্ধারা ঘুরে দঁড়ায়। তাদের প্রতি-আক্রমণে শত্রু রণে ভঙ্গ দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ভুলের মাশুল চড়া হয়ে গেছে।

চট্টগ্রাম সিটি কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র আমানুল্লাহ চৌধুরী ফারুক। কোনো ক্লাসেই সেকেন্ড হয়নি কখনো। বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার অম্বরনগর মিয়াবাড়ি। বাবা হালিমউল্লাহ চৌধুরীর বড় ছেলে। উপ-অধিনায়ক সালেহ আহমেদ মজুমদার, বুলু, ফারুক, আখতারুজ্জামান বাবু ও ইসমাইল শহীদ হয়। ১৭ জনের দলের পাঁচজনই শহীদ। মৃত্যুর কদিন আগে ফারুক এক প্রত্যয়দীপ্ত চিঠি লেখে তার বাবার কাছে। শেষে চেয়েছিল দোয়া। নদীতে জোয়ার আসে একটু পরেই। মারাত্মক আহত অবস্থায় ফারুক জোয়ারের পানিতে আটকে যায়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাঁতারাতেও পারছে না। সহযোদ্ধারা অস্ত্রটি ফেলে দিয়ে সাঁতরাতে বলে। ফারুক অস্ত্র ফেলতে নারাজ। জোয়ার ও নিয়তি দুই-ই তখন ফারুকের বিপক্ষে। জোয়ারের পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায় ফারুককে বঙ্গোপসাগরে।

বাবার কাছে লেখা ফারুকে চিঠি

জয়তু ফারুক

তাং ২৩-০৫-১৯৭১ ইং

জনাব বাবাজান

আজ আমি চলে যাচ্ছি। জানি না কোথায় যাচ্ছি। শুধু এইটুকু জানি, বাংলাদেশের একজন তেজোদৃপ্ত বীর স্বাধীনতাকামী সন্তান হিসাবে যেখানে যাওয়া দরকার আমি সেখানেই যাচ্ছি। বাংলারে বুকে বর্গী নেমেছে। বাংলার নিরীহ জনতার ওপর নরপিশাচ রক্তপিপাসু পাক-সৈন্যরা যে অকথ্য বর্বর অত্যাচার আর পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে। তা জানা সত্ত্বেও আমি বিগত এক মাস পঁচিশ দিন যাবত্ ঘরের মধ্যে বিলাস বাসনে মত্ত থেকে যে ক্ষমাহীন অপরাধ করেছি আজ সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে যাত্রা শুরু করলাম। সমগ্র বাঙ্গালীরা যেন আমায় ক্ষমা করতে পারেন। আপনি হয়তো দুঃখ পাবেন। দুঃখ পাওয়ারই কথা। যে সন্তানকে দীর্ঘ ষোল বছর ধরে তিল তিল করে হাতে কলমে মানুষ করেছেন, যে ছেলে আপনার বুকে বারবার শনি কৃপানের আঘাত এনেছে, যে ছেলে আপনাকে এতটুকু শান্তি দিতে পারেনি। অথচ আপনি আপনার সেই অবাধ্য দামাল ছেলেকে বারংবার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন, যার সমস্ত অপরাধ আপনি সীমাহীন মহানুভবতার সঙ্গে ক্ষমা করেছেন। আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন সম্ভবতঃ একটি মাত্র কারণে যে, আপনার বুকে পুত্র বাত্সলের রয়েছে প্রবল আর্কষণ।

আজ যদি আপনার সেই জ্যেষ্ঠ পুত্র ফারুক স্বেচ্ছায় যুদ্ধের ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, তাহলে আপনি কি দুঃখ পাবেন বাবা? আপনার দুঃখিত হওয়া সাজে না কারণ হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যদি নিহত হই, আপনি হবেন শহীদের পিতা।

আর যদি গাজী হিসেবে আপনাদের স্নেহছায়াতলে আবার ফিরে আসতে পারি তাহলে আপনি হবেন গাজীর পিতা। গাজী হলে আপনার গর্বের ধন হবো আমি। শহীদ হলেও আপনার অগৌরবের কিছু হবে না। আপনি হবেন বীর শহীদের বীর জনক। কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম নয়। ছেলে হিসেবে আমার আবদার রয়েছে আপনার ওপর। আজ সেই আবদারের ওপর ভিত্তি করেই আমি জানিয়ে যাচ্ছি বাবা, আমি তো প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী। আমার মনে কতো আশা, কতো স্বপ্ন। আমি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে যাবো। আবার কলেজ ডিঙ্গিয়ে যাবো বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে। মানুষের মতো মানুষ হবো আমি।

আশা শুধু আমি করিনি। আশা আপনিও করেছিলেন। স্বপ্ন আপনিও দেখেছেন। কিন্তু সব আশা, সব স্বপ্ন আজ এক ফুত্কারে নিভে গেলো। বলতে পারেন, এর জন্য দায়ী কে? দায়ী যারা সেই সব নর-ঘাতকদের কথা আপনিও জানেন। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ওদের কথা জানে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে—Mother and Motherland are more superior than haven. স্বর্গের চেয়েও উত্তম মা এবং মাতৃভূমি। আমি তো যাচ্ছি আমার স্বর্গদপী গরিয়সী সেই মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে। আমি যাচ্ছি শত্রুকে নির্মূল করে আমার দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। বাবা, শেষ বারের মতো আপনাকে একটা অনুরোধ করবো। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট সব সময় দোয়া করবেন, আমি যেন গাজী হয়ে ফিরতে পারি। আপনি যদি বদদোয়া বা অভিশাপ দেন, তাহলে আমার ভবিষ্যত্ অন্ধকার।

জীবনে বহু অপরাধ করেছি। কিন্তু আপনি আমায় ক্ষমা করেছেন। এবারও আপনি আমাকে ক্ষমতা করবেন, এই আশাই আমি করি। আপনি আমার শতকোটি সালাম নেবেন। আম্মাজানকে আমার কদমবুচি দেবেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলবেন। ফুফুআম্মাকেও দোয়া করতে বলবেন। ফয়সল, আফতাব, আরজু, এ্যানি ছোটদের আমার স্নেহশীষ দেবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন আর সব সময় হুশিয়ার থাকবেন।

ইতি

আপনার স্নেহের ফারুক

পাঁচ.

রণাঙ্গন থেকে যোদ্ধা লেখে, ‘মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোনো সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়’।

তারা তাদের সবটুকুই আমাদের জন্য দিয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের পাঠানো বার্তা পেলাম কই? চোখের দুই ফোঁটা নোনা জলও কি রেখেছি?

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত