মিত্র বাহিনী ঢাকার তিন দিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকে। ১৫ তারিখে একটি দল আসে সাভারের দিক থেকে, একটি ডেমরার দিক থেকে এবং অন্য একটি টঙ্গীর দিক দিয়ে। তবে ঢাকার উপকণ্ঠে সবার আগে পৌঁছে যান জেনারেল জি এস নাগরার অধীনস্থ সন্ত সিংয়ের দল। তারা ১৪ তারিখ রাত ১০টার দিকে এগিয়ে যায় সাভার-মিরপুরের দিকে। এরা ধামরাই ফেরির পশ্চিম দিকের ফেরিঘাট দখল করে কয়েক ঘণ্টা পর—ভোররাতে (১৫ ডিসেম্বর)। বেতার সম্প্রচার ভবনের কাছে পাকিস্তানিরা তাদের বাধা দিতে চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত পিছু হটে যায়। সন্ত সিংয়ের এই দলই সবার আগে পৌঁছে যায় মিরপুর ব্রিজের কাছে। এদের সঙ্গে ছিল কাদের বাহিনী।
তাড়াহুড়োতে পাকিস্তানিরা মিরপুরের ব্রিজ ধ্বংস করতে পারেনি। সেখানে লড়াই হয় ১৫ তারিখ রাতের বেলায়। এভাবে মেজর জেনারেল নাগরার অধীনে মিত্র বাহিনী পৌঁছে যায় একেবারে ঢাকার উপকণ্ঠে। ওদিকে, মিত্র বাহিনীর যে দলটি নরসিংদী-ডেমরার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, ১৫ তারিখে সেটি অবস্থান নেয় শীতলক্ষ্যার পুব তীরে। মোটকথা, ১৬ তারিখ মিত্র বাহিনী তিন দিক থেকে ঢাকায় পৌঁছে যায়।
ওদিকে, বৃদ্ধ গভর্নর মালিক ৮ তারিখ থেকেই প্রাণের ভয়ে আত্মসমর্পণ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কাছে তিনি আশ্রয় চেয়েছিলেন হোটেল ইন্টারকনে। অপরপক্ষে নিয়াজি ‘প্রাণ থাকতে এক ইঞ্চি জায়গা না-দেওয়ার’ নীতিতে অবিচল থাকায়, আত্মসমর্পণের বিষয়টি তখনই বেশি দূর এগোয়নি। কিন্তু ১৪ তারিখ নাগাদ তাঁর ভরসার পানি সবটুকুই ভাটার টানে বঙ্গোপসাগরে চলে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য গভর্নমেন্ট হাউসে সভা বসেছিল গভর্নর মালিকের নেতৃত্বে। নিয়াজি, ফরমান আলী, জামশেদ—সবাই ছিলেন সেখানে। এই সভার খবর পেয়ে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিয়ে ভারত মাঝারি সাইজের একটি বোমা ফেলে গভর্নমেন্ট হাউসের ওপর। তখন কর্তারা কে কোথায় পালাবেন, পথ পেলেন না। (ফরমান আলী লিখেছেন, সবাই পালালেও, তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা গাছের তলায়)। কিন্তু ভারত সত্যি সত্যি তাঁদের প্রাণে মারতে চায়নি। তাই একটি বোমা ফেলেই যা জানানোর তা জানিয়ে দিয়েছিল।
আত্মসমর্পণের কদিন আগে থেকেই ফরমান আলী বুঝতে পেরেছিলেন যে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই যুদ্ধের শেষ দিক থেকে তিনি পোড়া মাটির নীতি অনুসরণ করছিলেন। ঠান্ডা মাথায় ভেবেছিলেন, পরাজিত হলেও কী করে শত্রুর যদ্দূর সম্ভব বেশি ক্ষতি করা যায়। এরই জন্য তিনি পরিকল্পনা করেন, বিখ্যাত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের যতজনকে পাওয়া যায়, তাঁদের মেরে ফেলার। স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ যাতে এই বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের সেবা না পায়। আলবদর বাহিনীকে তিনি ভার দিয়েছিলেন ১৪ তারিখের মধ্যে তাঁর তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সবাইকে খুন করতে।
মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, আশরাফুজ্জামান, মঈনুদ্দীন প্রমুখ তখন আলবদর বাহিনীর প্রধান নেতা। ফরমান আলীর তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের যতজনকে খুঁজে পাওয়া যায়, আলবদর বাহিনী তাঁদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কাউকেই রেহাই দেয়নি। নির্যাতন করে মেরে ফেলে তাঁদের। এঁদের মধ্যে ছিলেন ডক্টর রাব্বি, ডক্টর আলীম চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষ ভট্টাচার্য প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তি। নিহতদের ১০ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ২৬ জন ডাক্তার। (একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায়?, ১৯৮৭; ও ফখরুল আবেদীনের তথ্যচিত্র আল-বদর দ্রষ্টব্য।)
১৫ তারিখে ঢাকার চারদিক থেকে মিত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রা দেখে নিয়াজির মতো আশাবাদীও বুঝতে পারলেন যে ঢাকার পতন একেবারে আসন্ন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াহিয়ার অনুমতি নিয়ে জাতিসংঘকে তিনি অনুরোধ জানান আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করতে। ভারতের প্রধান সেনাপতি মানেক্্শকেও জানালেন যে সৈন্যদের নিয়ে তিনি আত্মসমর্পণ করতে রাজি আছেন। অতঃপর বাকি থাকে কেবল আত্মসমর্পণের শর্ত আর ভাষা নিয়ে বিতর্ক। একে কি ‘আত্মসমর্পণ’ বলা হবে, নাকি বলা হবে ‘যুদ্ধবিরতি’। ভারতের তরফ থেকে জানানো হয় যে একে যুদ্ধবিরতি নয়, সরাসরি বলতে হবে আত্মসমর্পণ। তখন কথা ওঠে, কার কাছে আত্মসমর্পণ। ভারতের কাছে, না মুক্তিবাহিনীর কাছে? মুক্তিবাহিনী অথবা বাংলাদেশ, কোনোটাই নিয়াজি অথবা পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বলতে চাইছিলেন না। কিন্তু পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয় ‘ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথ বাহিনী’র কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করতে। ভারতের প্রধান সেনাপতি, জেনারেল মানেক্্শ তাই ১৫ তারিখ বিকেল পাঁচটা থেকে ১৬ তারিখ সকাল নয়টা পর্যন্ত বিমান হামলা না করার নির্দেশ দেন। যদিও অন্যান্য ফ্রন্টে—চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, নাটোর, খুলনা—প্রতিটি জায়গায় এ সময় যুদ্ধ চলতে থাকে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে মিত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রা।
পাকিস্তান যে ঢাকার কোনো জায়গায় সামান্যতম বাধা দেবে মিত্র বাহিনীকে, এর জন্য তাদের যথেষ্ট সৈন্য ছিল না। কী অসহায় হয়ে পড়েছিল পাকিস্তান, তার জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন সিদ্দিক সালিক তাঁর গ্রন্থে। তিনি তখনকার পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: কুর্মিটোলা বিমানক্ষেত্রে একজন ব্রিগেডিয়ার তাঁর মেজরকে প্রতিরক্ষার অবস্থা কেমন, সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে মেজর বললেন, আমি ঠিক আছি। কিন্তু একটি মাত্র মর্টার ও দুটি মেশিনগান দিয়ে বড় রকমের ভারতীয় আক্রমণ ঠেকাতে পারবে বলে সৈনিকেরা তেমন ভরসা পাচ্ছে না। তখন মেজরকে ব্রিগেডিয়ার বললেন সৈন্যদের উত্সাহ দিতে। আর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তরে ব্রিগেডিয়ার বকর পরামর্শ দিলেন ঢাকায় পথযুদ্ধ সংগঠন করতে। তার উত্তরে একজন বললেন, যে শহরের বাসিন্দারা শত্রুভাবাপন্ন, সেখানে পথযুদ্ধ করা যায় না। ‘একদিক থেকে ভারতীয়রা এবং অন্যদিক থেকে মুক্তিবাহিনী আপনাকে বেপথো কুকুরের মতো তাড়িয়ে তাড়িয়ে শিকার করবে।’ (সালিক, ১৯৮৮)
নিয়াজি তাই অগত্যা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে নিলেন। কিন্তু শর্ত দিলেন যে তাঁর সৈন্যদের মুক্তিবাহিনী ও বাঙালিদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। রাত দুইটায় তিনি বেতারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র তাঁর বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিলেন। তবে আত্মসমর্পণের পুরোপুরি আয়োজন করার জন্য সকাল ১০টার বদলে যুদ্ধবিরতির সময় রাখার সময় বাড়িয়ে নিলেন বেলা তিনটা পর্যন্ত।
পরের দিন—ষোলোই ডিসেম্বর—সকাল সাড়ে আটটায় জেনারেল গন্ধর্ব নাগরা মিরপুর ব্রিজের কাছ থেকে একটি বার্তাসহ তাঁর এডিসি মেজর শেঠি ও অন্য দুজন কর্মকর্তাকে জিপে করে পাঠালেন ঢাকা শহরে। জিপের ওপর উড়ছে সাদা পতাকা। নিয়াজির সঙ্গে আগে থেকেই নাগরার পরিচয় ছিল। তাই বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ভাষাতেই লিখেছিলেন, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখানে এসে গেছি। তোমার খেলা শেষ। আমার পরামর্শ হচ্ছে, তুমি আত্মসমর্পণ করো এবং আমি তোমার দেখাশোনা করব। গন্ধর্ব।’ (লছমন সিংহ, ১৯৮১)। কিন্তু পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক এই চিরকুটের কথা লিখেছেন একটু ভিন্নভাবে। এতে নাগরা নাকি লিখেছিলেন, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মীরপুর সেতুর কাছে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।’ নিয়াজি এই বার্তাটি পেয়েছিলেন নটার দিকে। (সালিক, ১৯৭৮)
বার্তাটি নিয়াজি দেখালেন তাঁর সহকারীদের। রাও ফরমান আলী খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এ বার্তা দেখে। আত্মসমর্পণের জন্য সকল দোষ তিনি চাপিয়েছিলেন নিয়াজির ওপর। (ফরমান আলী, ১৯৯২)। তারপর মেজর জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠালেন মিরপুরে। মিরপুরে এই গাড়ি পৌঁছানোর পর সঙ্গে সঙ্গে এই গাড়িতে উঠে বসেন মেহতা। অন্যরা ওঠেন একটা জিপে। একজনের হাতে ছিল একটা সাদা পতাকা। এই জিপ যখন মিরপুর ব্রিজের ওপর, তখন হঠাত্ পাশ থেকে মেশিনগানের একঝাঁক গুলি এসে আঘাত করে এই জিপটিকে। এতে গুরুতরভাবে আহত হন মেজর শেঠি। তাঁর একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছিল এই আঘাতের দরুন। মেহতা ও একজন পাকিস্তানি অফিসারকে পাঠানো হয় টঙ্গীতে। তাঁদেরও হাতে ছিল সাদা পতাকা। কিন্তু একটা ট্যাংকের গোলা এসে আঘাত করে তাঁদের জিপ। ফলে জিপের চারজন আরোহীর সবাই নিহত হন সেখানেই। (লছমন, ১৯৮১)। এ কি মিরপুর ব্রিজ এবং টঙ্গীতে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের ভুলে, না তারা কিছুতেই আত্মসমর্পণ মেনে নিতে পারছিল না বলে, তা জানার উপায় নেই। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতি তাদের আন্তরিক ঘৃণার পরিচয় দিয়েছিল। টঙ্গীতে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল বিকেল চারটার দিকে।
সে যা-ই হোক, ১০টা চল্লিশে কয়েকজন সৈন্য আর কাদের সিদ্দিকী এবং তাঁর কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে জেনারেল নাগরা প্রবেশ করলেন ঢাকায়। ‘প্রবেশ করলেন গৌরবের শিরোপা ধারণ করে। এটা ছিল ঢাকার পতন। পতন ঘটল নীরবে—একজন হূদরোগীর মতো। কোনো অঙ্গচ্ছেদ হলো না অথবা দেহও দ্বিখণ্ডিত হলো না।’ (সালিক, ১৯৮৮)। সালিক এটা তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে পতন বললেও বাঙালিদের দৃষ্টিতে এ ছিল ঢাকা বিজয়। এ ছিল নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের অবসান। স্বাধীন বাংলাদেশের সত্যিকার অভ্যুদয়।
নাগরাকে অভ্যর্থনা জানালেন নিয়াজি। পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে তিনি নাকি তাঁর কাঁধে মুখ রেখে কেঁদেছিলেন। (তালুকদার, ১৯৯১)। তারপর উর্দু বয়াত আবৃত্তি করতে আরম্ভ করেন তিনি। কিন্তু নাগরা কি উর্দু বোঝেন? নিয়াজি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন। নাগরা উত্তরে বলেছিলেন যে তিনি লাহোর থেকে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেছিলেন। নাগরা বেশি শিক্ষিত দেখে নিয়াজি কবিতা আবৃত্তি না করে রসিকতা করতে আরম্ভ করেন। (ফারমান আলী, ১৯৯২; সালিক, ১৯৮৮)। এই রসিকতা নাকি এতই স্থূল ছিল যে তা ছাপা যায় না। (সালিক, ১৯৮৮)। সে যা-ই হোক, এরপর নাগরা আর নিয়াজির আলোচনা হলো। সে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বাঘা সিদ্দিকীও। সেটাও ফরমান আলীদের গাত্রদাহের সৃষ্টি করেছিল। (ফরমান আলী, ১৯৯২)। আলোচনার পর সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা নাগরা জানালেন ইস্টার্ন কম্যান্ডের প্রধান জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরার কাছে।
অরোরার নির্দেশে তাঁর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে ঢাকায় এলেন দুপুরের পর। এতে লেখা ছিল:
পাকিস্তানের ইস্টার্ন কম্যান্ড বাংলাদেশে তার সমস্ত সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্বাঞ্চলের ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল অফিসার্স কম্যান্ডিং ইন চিফের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হচ্ছে। পাকিস্তানের স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী এবং তার তাবত প্যারা-মিলিটারি ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী এই আত্মসমর্পণের অন্তর্ভুক্ত। এরা জগজিত্ সিং অরোরার নির্দেশাধীন সবচেয়ে নিকটবর্তী বাহিনীর কাছে তাদের অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করবে।
‘আত্মসমর্পণ’ এবং ‘বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ কথা কটি তখনো নিয়াজির সহকারীরা ঠিক মেনে নিতে চাইছিলেন না। বিশেষ করে ফরমান আলী। কিন্তু মেজর জেনারেল জ্যাকব বলেন যে দলিলটি এভাবেই দিল্লি থেকে এসেছে। ইচ্ছে করলে তাঁরা এভাবেই একে গ্রহণ করতে পারেন, অথবা অগ্রাহ্য করতে পারেন। (ফরমান আলী, ১৯৯২) মৌন থেকে নিয়াজি তখন তাঁর সম্মতি জানালেন। তিনি নিজে অবশ্য তাঁর বইতে ঘটনাটা ঠিক এভাবে বর্ণনা করেননি। তিনি লিখেছেন যে জেনারেল জ্যাকব তাঁকে এই বলে ভয় দেখিয়েছিলেন যে, শর্ত পুরোপুরি মেনে না নিলে পাকিস্তানের অনুগত লোকদের তিনি তুলে দেবেন মুক্তিবাহিনীর হাতে। আর তুলে দেবেন হোটেল ইন্টারকনে, যে বেসামরিক লোকেরা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের। এই হুমকির মুখে তিনি বাধ্য হয়ে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের শর্তে রাজি হন। (নিয়াজি, ২০০৮)
অপরাহে নিয়াজি যান বিমানবন্দরে—লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরাকে অভ্যর্থনা জানাতে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জেনারেল অরোরার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এ কে খন্দকার। সালিক এই দৃশ্যের ভালো বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি (অরোরা) পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে এলেন। এক বিরাটসংখ্যক বাঙালি জনতা ছুটে গেল তাদের ‘মুক্তিদাতা’ ও তাঁর পত্নীকে মাল্যভূষিত করতে। নিয়াজি তাঁকে স্যালুট দিলেন এবং করমর্দন করলেন। একটি মর্মস্পর্শী দৃশ্য। বিজয়ী এবং বিজিত দাঁড়িয়ে আছেন প্রকাশ্যে, বাঙালিদের সামনে। আর বাঙালিরা অরোরার জন্যে তাদের ভালোবাসা এবং নিয়াজির জন্যে তীব্র ঘৃণা প্রকাশে কোনো রকম গোপনীয়তার আশ্রয় নিচ্ছে না।
উচ্চকণ্ঠে চিত্কার ও স্লোগানের মধ্য দিয়ে তাঁদের গাড়ি রমনা রেসকোর্সে এল। আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ তৈরি করা হয়। বিশাল ময়দানটি বাঙালি জনতার উদ্বেল আবেগে ভাসছিল। তারা প্রকাশ্যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলের দর্পচূর্ণের দৃশ্য দেখবার জন্যে উদ্্গ্রীব হয়ে উঠেছিল।...
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দলকে হাজির করা হলো বিজয়ীকে গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্যে। অন্যদিকে একটি ভারতীয় সেনাদল বিজিতের প্রহরায় নিযুক্ত হলো। প্রায় দশ লাখ বাঙালি এবং কয়েক কুড়ি বিদেশী সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন। আত্মসমর্পণের নিদর্শনস্বরূপ জেনারেল নিয়াজি তাঁর রিভলবার বের করে অরোরার হাতে তুলে দিলেন। (সালিক, ১৯৮৮)
এই পরাজয়ে নিয়াজির মনের অবস্থা তখন কেমন ছিল? নিয়াজি নিজেই তার বর্ণনা দিয়েছেন:
আমি কাঁপা হাতে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করি। তখন আমার অন্তরে উত্থিত আবেগের ঢেউ দু চোখ বেয়ে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে। অনুষ্ঠানের একটু আগে একজন ফরাসি সাংবাদিক এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন আপনার অনুভূতি কী, টাইগার?’ জবাবে আমি বললাম, ‘আমি অবসন্ন।’ (নিয়াজি, ২০০৮)
সালিক ও নিয়াজী—দুজনই আত্মসমর্পণের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেও, একটা জিনিস উল্লেখ করেননি। ইচ্ছে করেই করেননি। এটা হলো: কেবল অরোরার ভারতীয় বাহিনীর কাছে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেননি, সেখানে সাক্ষী হিসেবে বাংলাদেশ বাহিনীর পক্ষ থেকে এ কে খন্দকারও ছিলেন। অর্থাত্ পাকিস্তান কেবল ভারতীয় বাহিনীর কাছে নয়, আত্মসমর্পণ করেছিল যৌথ বাহিনীর কাছে।
যুদ্ধে মিত্র বাহিনী এত দ্রুত জয়ী হওয়ার কারণ এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। গেরিলারা ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানিদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল। তাদের মনোবলও ভেঙে দিয়েছিল। বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীও বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায় নয় মাস ধরে যুদ্ধ করে। এর ফলে পাকিস্তানি সেনারা কোনো বিরাম অথবা বিশ্রাম পায়নি, বরং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল নিজেদের ঘাঁটিগুলোর মধ্যে। বস্তুত তারা আগে থেকেই পরাজিতের মনোভাব নিয়ে বসে ছিল। মিত্র বাহিনী প্রতিটি সীমান্ত দিয়েই প্রবেশ করেছিল একযোগে। বাংলাদেশ বাহিনীই তাঁদের সোজা পথ দেখিয়েছিল। সেই পথ ধরে এবং জনগণের সহযোগিতায় ভারতীয় বাহিনী অত সহজে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছিল। বিমানবাহিনীর প্রতিটি আক্রমণেও সহপাইলট হিসেবে সঙ্গে থাকতেন একজন বাঙালি পাইলট। এমনকি পয়লা ডিসেম্বর চট্টগ্রামের জ্বালানি ডিপোর ওপর আক্রমণও করেছিলেন শুধু দুজন বাঙালি পাইলট মিলে—ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম আর ক্যাপ্টেন আকরাম। (মনিরুজ্জামান, ১৯৮০)। ভারতীয় ও পাকিস্তানি জেনারেলরা তাঁদের গ্রন্থে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকাকে অত গুরুত্ব দেননি। কিন্তু এটা তাঁদের ওপর চরম অবিচার এবং তাঁদের ভূমিকার অবমূল্যায়ন।
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য গোলাম মুরশিদের বই মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর থেকে
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত