বিজ্ঞাপন
default-image

স্বাধীনতাযুদ্ধের নয় মাস ধরে মুক্তিবাহিনীর অবিশ্রান্ত ছোট-বড় আক্রমণ এবং স্থানীয় জনসাধারণের সর্বাত্মক অসহযোগিতার ফলে হানাদার বাহিনী দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছিল। চূড়ান্ত পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ রকম পরিস্থিতিতে স্বাধীনতাযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর আর সমাপ্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর। পাকিস্তানি বাহিনী এ দিন বিকালে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

চূড়ান্ত পর্বে মিত্রবাহিনী সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বড় বড় শহরগুলোর দিকে অগ্রাভিযান চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে যুদ্ধশেষে বা যুদ্ধ না করেই পশ্চাদপসরণ করে বড় বড় শহর, বিশেষ করে যেখানে সেনানিবাস ছিল এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে উন্নত ছিল সেখানে সম্মিলিত হতে থাকে। ১৩/১৪ ডিসেম্বরের পর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন সদর দপ্তর এবং ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো কোনো ইউনিটের ছোট ছোট অংশ চতুর্দিক থেকে ঘেরাও হয়ে মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই আত্মসমর্পণ করে। পশ্চাদপসরণ বা ঘেরাওকালেও অনেক পাকিস্তানি সৈনিক দলছুট হয়ে এককভাবে আত্মসমর্পণ করে।

default-image

চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মিত্রবাহিনীর দায়িত্ব ছিল শিলিগুড়ি ও বালুরঘাট থেকে আক্রমণ চালিয়ে এই এলাকা মুক্ত করে দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। মিত্রবাহিনীতে ছিল ভারতীয় ৩৩ কোর (৬ ব্রিগেড সংবলিত) এবং বাংলাদেশের ৬ ও ৭ নং সেক্টর। মিত্রবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন লে. জেনারেল এমএল তাপান, আর কোর সদর দপ্তর ছিল শিলিগুড়িতে। বিপরীতে পাকিস্তানি বাহিনীর দায়িত্ব ছিল উত্তরাঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখা, এ জন্য ছিল ১৬ ইনফেন্ট্রি ডিভিশন (৪ ব্রিগেড সংবলিত) এবং কিছু আধাসামরিক বাহিনী (ইপকাফ) ও রাজাকার বাহিনী। হানাদার বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল নাজার হোসেন আর ডিভিশন সদর দপ্তর ছিল নাটোরে, তবে যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে বগুড়ায় সরিয়ে আনা হয়।

চূড়ান্ত পর্বে মিত্রবাহিনীর অগ্রাভিযানের চাপে অন্যান্য এলাকার মতো পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্ত ছেড়ে সেনানিবাস বা শক্ত ঘাঁটিতে চলে আসে। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি জায়গায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেও মোটামুটিভাবে তারা সৈয়দপুর, রংপুর, নবাবগঞ্জ (দিনাজপুর), বগুড়া, নওগাঁ, নাটোর ও ঈশ্বরদীতে দলগতভাবে জমায়েত হয়। ১২ ডিসেম্বরের পর থেকে উত্তরাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ শুরু হয়ে যায়, যদিও তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের কোনো সিদ্ধান্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ে হয়নি, ওই তারিখে গোবিন্দগঞ্জে (রংপুর) কিছু পাকিস্তানি সৈনিক মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৩ ডিসেম্বর সৈয়দপুর থেকে পাঁচ মাইল দূরে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক ও একজন অফিসারসহ প্রায় ১০৭ জন পাকিস্তানি সৈনিক মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অবরুদ্ধ বগুড়া সেনানিবাস থেকে একজন অফিসার ও একজন জেসিও বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করে। এর পরপর একই জায়গা থেকে নয়জন অফিসার, ১৫ জন জেসিও এবং ১৪৫ জন সৈনিক আত্মসমর্পণ করে। এর পর থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় অনেকেই সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করতে থাকে।

default-image

১৪ ডিসেম্বর রাত থেকে ভারতীয় বেতারের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কীভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে তাও বেতারের মারফত প্রচার করা হয়। একই সময়ে ভারতীয় বাহিনীর সেনাপতি জেনারেল মানেক শ-র স্বাক্ষরযুক্ত আত্মসমর্পণের জন্য প্রচারপত্র বিমান মারফত বিলি করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলে অবরুদ্ধ সদর দপ্তরগুলোকে তা অবহিত করা হয় এবং নির্দেশ দেওয়া হয় কাছের মিত্রবাহিনী কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। এ দিন বিকেল থেকেই প্রতিপক্ষ দলগুলো একে অপরে সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে।

রংপুর, সৈয়দপুর, নবাবগঞ্জ (দিনাজপুর), বগুড়া ও নওগাঁয় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শিগগিরই করা সম্ভব হলেও, ঈশ্বরদী ও নাটোরে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান দেরিতে হয়। কারণ এসব জায়গায় পাকিস্তানি সৈনিকদের একত্র করতে এবং ভারতীয় বাহিনীর প্রস্তুত হতে কিছু সময় লেগে যায়।

১৬ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল মানজুর সৈয়দপুরের কিছু পূর্ব দিকে অবস্থিত ২১ রাজপুত ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। ২১ রাজপুত ব্যাটালিয়ন থেকে এ সংবাদ জানার পর ৭১ মাউনটেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার পিএন কাটপালিয়া ২৩ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ সাফিকে বেলা আড়াইটায় সৈয়দপুর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে দারওয়ানিতে আলোচনার জন্য আহ্বান করেন।

ছয় মাউনটেন ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল পিসি রেড্ডি ব্রিগেডিয়ার কাটপালিয়াকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দারওয়ানি পাঠান। বিকালে উভয়পক্ষের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়, ১৭ ডিসেম্বর বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে ২৩ ব্রিগেডসহ অন্যরা সৈয়দপুরের জামজামা বিমানবন্দরে আত্মসমর্পণ করবে। ১৭ ডিসেম্বর বিকালে জামজামা বিমানবন্দরে ব্রিগেডিয়ার সফি তার পিস্তল ব্রিগেডিয়ার কাটপালিয়ার কাছে সমর্পণের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। অতঃপর ২৬ এফএফের অধিনায়ক লে. কর্নেল হাকিম আরশাদ কোরেশী সব সৈনিককে অস্ত্র সমর্পণের আদেশ দেন। ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের ১১১ জন অফিসার, ১৫৫ জন জেসিও এবং চার হাজার ৫১১ জন সৈনিক সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করে।

১৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর রংপুর সেনানিবাস থেকে ৩৪ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মীর আবদুল নাঈম সাদা পতাকা নিয়ে রংপুর শহরের কাছাকাছি ২০২ মাউনটেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এফপি ভাট্টির কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এ সময় মিত্রবাহিনী রংপুর অবরোধ করে রেখেছিল। উভয় পক্ষ আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা করে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে দেখে ওই দিন আত্মসমর্পণ স্থগিত রাখা হয় এবং ১৭ ডিসেম্বর রংপুর সেনানিবাসে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ৬৬ মাউটনটেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জিএস শার্মা। একই তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যান্য ইউনিট ও ব্রিগেড থেকে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব আসতে থাকে। ২০ মাউনটেন ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল লাচমান সিং তাঁর ব্রিগেড কমান্ডারদের বিভিন্ন জায়গায় আত্মসমর্পণের দায়িত্ব দিয়ে পাঠান।

১৭ ডিসেম্বর দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে পরাজিত বাহিনী ২০২ মাউনটেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এফপি ভাট্টির কাছে অস্ত্রসমর্পণ করে।

বগুড়া পতনের আগে জেনারেল নাজার নাটোরে পালিয়ে যান। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যে বগুড়া সেনানিবাস মিত্রবাহিনীর দখলে আসে। ১৭ ডিসেম্বর জেনারেল লাছমান সিং আত্মসমর্পিত দুজন পাকিস্তানি লে. কর্নেলকে নিরাপত্তা দলসহ নাটোর পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের জন্য জেনারেল নাজারকে বগুড়া আনার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় ১৬৫ মাউনটেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার রাঘুবির সিং পান্নুকে নাটোর পাঠিয়ে হেলিকপ্টারে করে ১৮ ডিসেম্বর জেনারেল নাজারকে বগুড়া আনা হয়। ওই দিনই বগুড়া সেনানিবাসে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। জেনারেল নাজার হুসেন শাহ উত্তরাঞ্চলের পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল লাছমান সিংয়ের কাছে নিজের পিস্তলটি গুলিশূন্য করে সমর্পণ করেন।

যুদ্ধশেষে ১৩ এফএফ ব্যাটালিয়ন নওগাঁয় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৮ ডিসেম্বর মেজর চন্দ্র শেখরের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী নওগাঁ শহরে প্রবেশ করে। এ দিন সকাল সাড়ে ১১টায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ২০০০ সৈন্য নওগাঁ কোর্ট থেকে কেডি স্কুল পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে মাটিতে অস্ত্র রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে কেডি স্কুল, ডিগ্রি কলেজ ও হাসপাতাল মাঠে পাকিস্তানি বাহিনী মেজর চন্দ্রশেখরের কাছে ভারি অস্ত্র সমর্পণ করে। এই আনুষ্ঠানিকতায় ৭ নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন গিয়াস চাৈধুরী উপস্থিত ছিলেন।

২১ ডিসেম্বর সকালে নাটোর রাজবাড়ীতে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ৯৩ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার নওয়াব আহেমদ আশরাফ ব্রিগেডিয়ার পান্নুর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তার অস্ত্র সমর্পণ করেন। ৭ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী নাটোরে ১৫১ অফিসার, ১৯৮ জন জেসিও, পাঁচ হাজার ৫০০ সৈনিক ও এক হাজার ৮৫৬ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য এবং নয়টি ট্যাঙ্ক, ২৫টি কামান ও ১০ হাজার ৭৭৩টি ক্ষুদ্র অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। একই দিন দুপুরের পর ব্রিগেডিয়ার পান্নু পাবনার ঈশ্বরদীতে আসেন এবং এখানে সম্মিলিত পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

উত্তরাঞ্চলে হানাদার বাহিনীর মোট ৩০৪ জন অফিসার, ৩৭১ জন জেসিও, ১১ হাজার ২১৮ জন অন্যান্য পদবির সৈনিক এবং প্রায় তিন হাজার আধাসামরিক বাহিনী/রাজাকার সদস্য মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। উত্তরাঞ্চলের সব আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈন্য, ভারি অস্ত্রশস্ত্র ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতে স্থানান্তর করা হয়।

[email protected]

সূত্র:

১. ইন্ডিয়ান সোর্ড স্ট্রাইক ইন ইস্ট পাকিস্তান : মে. জেনারেল লাচমান সিং, বিকাশ পাবলিশিং হাউস প্রাইভেট লিমিটেড, ভারত, ১৯৭৯।

২. ট্র্যাজেডি অব এরর: লে. জে. (অব.) কামাল মতিনউদ্দীন।

৩. দি ১৯৭১ ইন্ডো-পাকিস্তান ওয়ার: মেজর জেনারেল হাকিম আরশাদ কোরেশী, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪।

৪. মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী: মনসুর আহমদ খান, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৪।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত