বিজ্ঞাপন
default-image

তখন শ্রাবণ মাস, হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। একটু গরমও পড়েছে। রাত ১০টার দিকে একটি সামরিক ট্রাক এসে থামে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা শহরে শিক্ষক হাফিজউদ্দীনের বাড়ির সামনে। হাফিজউদ্দীন তখন প্রাচীরঘেরা একতলা বাড়িটির ঘরের বারান্দায় ঘুমাচ্ছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার সেনারা ট্রাক থেকে নেমেই বাড়িটি ঘিরে ফেলে। তারা হাফিজউদ্দীনকে ঘুম থেকে তুলে পিছমোড়া করে বেঁধে ট্রাকে তুলে নেয়।

স্থানীয় রাজাকারদের দেওয়া তালিকা ধরে হানাদার সেনারা সেই রাতে গাংনী উপজেলার আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে তাদের ক্যাম্প ভাটপাড়া কুঠিবাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁদের গুলি করে হত্যা করে দুদিন খোলা আকাশের নিচে মৃতদেহগুলো ফেলে রাখে। তারপর পচন ধরা মৃতদেহগুলো তারা পাশের কাজলা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ঘটনাটি একাত্তরের ১৫ আগস্টের।

শহীদ হাফিজউদ্দীন ছিলেন গাংনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আবদুল্লাহ–আল-আমিন শহীদ হাফিজউদ্দীনের ছবি এবং তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা পাঠান। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়।

সমাজসেবক ও মুক্তচিন্তার মানুষ হাফিজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহায়তায় গড়ে ওঠে গাংনী উচ্চবিদ্যালয় ও গাংনী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। সরাসরি রাজনীতি না করলেও ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। তাঁর চতুর্থ ছেলে একরামুল হক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে একাত্তরের ১০ সেপ্টেম্বর মেহেরপুর সদরের পিরোজপুর ইউনিয়নের কাঁঠালপোতা গ্রামে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।

শহীদ হাফিজউদ্দীনের জন্ম ১৯২০ সালে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার চৌগাছা গ্রামে। তাঁর বাবা আজিজউদ্দীন বিশ্বাস ছিলেন মেদিনীপুর জমিদারির গোমস্তা। মা সবুরা খাতুন গৃহিণী। নদীয়া জেলার শিকারপুর হাইস্কুলে পড়াশোনার পর ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এন্ট্রান্স পাস করেন তিনি। কর্মজীবন শুরু করেন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে। পরে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থানার দারোগার পদ ছেড়ে নিজ এলাকায় শিক্ষকতা ও শিক্ষাবিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন।

সাহিত্যিক রফিকুর রশীদের লেখা আগামী প্রকাশনীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা গ্রন্থে হাফিজউদ্দীনকে ‘গাংনী থানার শিক্ষাবিস্তারের অগ্রদূত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর এবং মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আবদুল্লাহ আল আমিনের ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকের বাংলাদেশ গ্রন্থে (ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) শিক্ষক হাফিজউদ্দীনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনিসহ একাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, চলছে বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ।

হাফিজউদ্দীনের স্ত্রী সাকিনা বেগম এবং দুই ছেলে বজলুল হক, সিরাজুল হক ও বড় মেয়ে মারা গেছেন। তিন ছেলে ও তিন মেয়ে বেঁচে আছেন। তাঁরা সবাই সরকারি চাকুরে। ছোট ছেলে গাংনী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বাবা, ভাই ও এক মামা শহীদ হয়েছেন। দেশের জন্য আমাদের পরিবার অনেক কষ্ট ও দুর্ভোগ সহ্য করেছে। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগের কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। তাঁদের নামে এলাকায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সড়ক বা স্থাপনার নামকরণ করা হয়নি।’

গ্রন্থনা: আবু সাঈদ, মেহেরপুর