বিজ্ঞাপন
default-image

তখন বৈশাখ মাস, বাড়িতে চলছিল পিঠা তৈরির ধুম। নজরুল ইসলামের সদ্য বিয়ে হয়েছে। হঠাৎ রাত ১১টায় বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খোলামাত্র একদল পাকিস্তানি হানাদার সেনা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তারা নজরুল ইসলাম ও ছোট ভাই আনোয়ারুল ইসলামকে পিছমোড়া করে বেঁধে গাড়িতে তোলে। মেহেরপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পুরোনো ভবনের সামনে অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে তাঁদের হত্যা করে। ঘটনাটি একাত্তরের ৩০ এপ্রিলের।

শহীদ নজরুল ইসলাম শিক্ষকতা ছাড়াও বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে চাকরি করেছেন। মেহেরপুর অঞ্চলে প্রগতিশীল সাহিত্য–সংস্কৃতির অন্যতম সংগঠক ছিলেন। এলাকার তরুণদের নিয়ে নিয়মিত পাঠচক্র ও আলোচনার আয়োজন করতেন। ভালো ছবি আঁকতেন, পোস্টার ডিজাইন করতেন। ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে অংশ নিয়েছেন ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আবদুল্লাহ আল-আমিন নজরুল ইসলামের ছবি ও তাঁর জীবনকর্ম নিয়ে লেখা পাঠান। নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৬ সালে ভারতের নদীয়া জেলার মহিষখোলা গ্রামে। বাবা আবদুর রহমান বিশ্বাস ছিলেন মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির গোমস্তা। মা খালেছা বেগম ছিলেন গৃহিণী। দেশভাগের পর মেহেরপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি চুয়াডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে মাধ্যমিক, যশোর সরকারি এমএম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবন শুরু করেন খুলনার খালিশপুর বঙ্গবাসী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। পরে তিনি খুলনা স্টার জুট মিল ও সর্বশেষ খুলনায় একটি বিদেশি বাণিজ্যিক কোম্পানিতে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের নিয়ে মার্চ ও এপ্রিলজুড়ে মেহেরপুর শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দেয়। ৩০ এপ্রিল নজরুল ও আনোয়ারুল দুই ভাইকে ছাড়াও মেহেরপুর সদরের গোভীপুর গ্রাম থেকে আটজন মুক্তিকামী বাঙালিকে ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে তারা। পরদিন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পেছনে একটি আমগাছের নিচে গণকবর দেয় তাঁদের। মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা রয়েছে। আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রফিকুর রশীদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা, অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তোজাম্মেল আযমের মুজিবনগর: যুদ্ধজয়ের উপাখ্যান বইয়ে শহীদ নজরুল ইসলাম এবং তাঁর ভাইয়ের আত্মদানের কথা রয়েছে।

নজরুল ইসলামের ভাইয়ের মেয়ে স্থানীয় কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিলের প্রধান শিক্ষক সানজিদা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দুই চাচা দেশের জন্য জীবনদান করলেও এর কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই। এটা আমাদের পরিবারের জন্য খুবই বেদনাদায়ক।’

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম রসুল বলেন, একাত্তরে হানাদারেরা মেহেরপুরের অনেক মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করেছে। নজরুল ইসলাম ও আনোয়ারুল ইসলাম সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদান রয়েছে। নানা কারণে হয়তো তাঁদের নাম মন্ত্রণালয়ে তালিকাভুক্ত হয়নি। তাঁদের সরকারি স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

গ্রন্থনা: আবু সাঈদ, মেহেরপুর