বিজ্ঞাপন
default-image

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে চাপরি গ্রাম। ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে বংশাই নদ। একাত্তরে গ্রামের মানুষ প্রায়ই বংশাইয়ের স্রোতে ক্ষতবিক্ষত লাশ ভেসে যেতে দেখতেন। মে মাসের এক বিকেলে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি লাশ ভেসে যাচ্ছিল। এর একটি আটকা পড়ে নদের বাঁকে। স্থানীয়রা ভেবেছিলেন লাশ, কিন্তু সামনে গিয়ে দেখেন মানুষটি বেঁচে আছেন। হাত ও ঠোঁট নড়ছে।

খবর পেয়ে ছুটে আসেন ওই গ্রামের চিকিৎসক শুধাংশু মোহন সাহা। গুরুতর আহত মানুষটিকে তিনি নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে দুই মাস চিকিৎসা করে সুস্থ করেন। লোকটির নাম সাধন ভট্টাচার্য, মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকেসহ ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মির্জাপুর থেকে ৭ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাম্পে ধরে আনে। নির্যাতন চালানোর পর আরও অনেকের সঙ্গে তাঁকেও গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে বংশাই নদে ভাসিয়ে দেয়।

সাধন ভট্টাচার্য ভাগ্যের জোর আর শুধাংশু মোহনের চিকিৎসায় বেঁচে গেলেন। কিন্তু চিকিৎসক শুধাংশু মোহন নিজে বাঁচতে পারলেন না। সর্বশেষ ৫ আগস্ট আহত মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমানের পেটে অস্ত্রোপচার করেন শুধাংশু মোহন। ওই দিন সকালে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার রাঙ্গামাটিয়ায় সম্মুখযুদ্ধে পেটে গুলিবিদ্ধ হন মজিবর।

শহীদ শুধাংশু মোহন সাহার পুত্রবধূ লক্ষ্মীরানী সাহা জানান, একাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোরে একদল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার তাঁদের বাড়ি ঘেরাও করে। ঘাতকের দল শুধাংশু মোহন সাহা, আত্মীয় বাবুল সাহা, গণেশ দত্ত ও বাড়ির পাচক লঙ্কেশ্বরকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁরা আর ফিরে আসেননি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ক্যাম্পে নিয়ে তাঁদের নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় বংশাই নদে।

শুধাংশু মোহন শুধু চিকিৎসাসেবার মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেননি। যুদ্ধ শুরুর পর এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ ও প্রশিক্ষণে সহায়তা করেন। তাঁর দুই ভাতিজা তপন কুমার সাহা ও শিশির কুমার সাহা, আত্মীয় নারায়ণচন্দ্র সাহাও সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা সামাদ তালুকদার জানান, শুধাংশু মোহনের নির্দেশনামতোই এলাকার অনেক যুবকের সঙ্গে তিনি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করা, ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করা ও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়ার কারণেই তাঁকে হানাদার সেনারা হত্যা করে।

শুধাংশু মোহন সাহার জন্ম ১৯১৩ সালে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বল্লা গ্রামে। বাবা অশ্বিনী কুমার সাহা, মা বসন্ত বালা সাহা। তিনি কলকাতা থেকে এলএমএফ পাস করে এলাকায় চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। তাঁর বাবা ছিলেন বড় ব্যবসায়ী ও জোতদার। ১৯৬৮ সালে তিনি নিজের জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন চাপরি গণ উচ্চবিদ্যালয়।

মধুপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা পরিষদ চত্বরে স্থাপিত শহীদ স্মৃতিসৌধে প্রথম নামটিই শহীদ শুধাংশু মোহন সাহার। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক শফিউদ্দিন তালুকদারের একাত্তরের গণহত্যা গ্রন্থেও তাঁর জীবনী আছে।

শুধাংশু মোহনের স্ত্রী প্রজাপতি সাহা এবং তিন সন্তান সুনীল কুমার সাহা, অনিল কুমার সাহা ও মায়ারানী সাহা—কেউ জীবিত নেই। নাতি লিটন কুমার সাহা জানান, মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখলেও তাঁর দাদুর নাম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শহীদ গেজেটে তালিকাভুক্ত হয়নি।


গ্রন্থনা: কামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল