বিজ্ঞাপন
default-image

‘“আমি যদি শহর ছেড়ে পালিয়ে যাই, তাহলে এ শহরের বাঙালিরা ঝুঁকিতে পড়বে।” অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এ কথা বলেছিলেন আমার বাবা।’ চোখ ছলছল করছিল অধ্যাপক সাখাওয়াৎ হোসেনের। বাবা শহীদ চিকিৎসক শামসুল হকের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তিনি।

সৈয়দপুর শহরের বাঙালিপুরের বাড়িতে কথা হচ্ছিল সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা শামসুল হক ছিলেন জনপ্রিয় চিকিৎসক ও সৈয়দপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। একাত্তরের মার্চে পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে উঠলে ২৩ মার্চ আমাদের পুরো পরিবার সৈয়দপুর শহর ছেড়ে পাশের গ্রাম ধলাগাছে চলে যায়। বাবা থেকে যান শহরের বাসাতেই। যুদ্ধ শুরু হলে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বাড়িটি ঘেরাও করে বাবাকে তুলে নিয়ে যায়।’

শহীদ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩১ সালে দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার উত্তর পলাশবাড়ী গ্রামে। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে সৈয়দপুর শহরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থের চিকিৎসকদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক বায়েজিদ খুরশিদ রিয়াজের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ গ্রন্থেও শামসুল হকের জীবনী রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে অবাঙালি (বিহারি) অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহরও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। সৈয়দপুরে গঠন করা হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শামসুল হক। তাঁর নেতৃত্বে শহরে স্বাধীনতার তুমুল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় সাংসদ চিকিৎসক জিকরুল হক (তিনিও শহীদ হন) টেলিফোনে তাঁকে পরামর্শ দিতেন।

সাখাওয়াৎ হোসেন জানান, ২৮ মার্চ সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি তাঁদের বাড়ির সামনে আসে। এক সেনাকর্তা তাঁকে জানান, শামসুল হককে সৈয়দপুর সেনানিবাসের কোয়ার্টার গার্ডে বন্দী করে রাখা হয়েছে। পরপর দুই দিন তিনি খাবার ও কিছু কাপড় নিয়ে সেনানিবাসে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে ভেতরে যেতে দেওয়া হয়নি। স্থানীয় অবাঙালিরা তাঁদের বাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। পরে তাঁরা ভারতের আকাশবাণী শিলিগুড়ি কেন্দ্রের খবরে জানতে পারেন, সৈয়দপুর সেনানিবাসের কোয়ার্টার গার্ডের বন্দীদের রংপুর সেনানিবাসের কাছে নিসবতগঞ্জ বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞ থেকে চারজন বেঁচে যান। তাঁরা ভারতে গিয়ে আকাশবাণীকে এসব তথ্য দিয়েছেন।

সাখাওয়াৎ হোসেন সৈয়দপুর সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তিনি জানান, তাঁরা সাত ভাইবোনের মধ্যে দুজন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। বাকিরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। মা বেগম রিজিয়া হক ২০০৬ সালের ৮ মার্চ মারা যান। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শামসুল হকের পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন। একাধিকবার অর্থসহায়তা দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁদের পরিবারকে রেলওয়ে একটি রেশন দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। সৈয়দপুর শহরে শহীদ ডা. শামসুল হকের নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

গ্রন্থনা: এম আর আলম, প্রতিনিধি, সৈয়দপুর, নীলফামারী