সন্তোষ কুমার দাস পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে যখন শহীদ হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৩ বছর। তিনি ছিলেন তৎকালীন গোপালগঞ্জ কায়েদে আজম মেমোরিয়াল কলেজের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কলেজ) দর্শন বিভাগের শিক্ষক। গান ও আবৃত্তি করতেন, যুক্ত ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও।
ফরিদপুরের প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোপালগঞ্জের দুজন শিক্ষকের ওপর ক্ষোভ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর। তাঁদের একজন সন্তোষ কুমার দাস, অন্যজন বৈলতলী সাহাপুর সম্মিলনী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোবিন্দ ঠাকুর। নরপশু পাকিস্তানি সেনারা দুজনকেই গুলি করে হত্যা করে।
সন্তোষ কুমার দাসের জন্ম ফরিদপুরে, ১৯৩৮ সালের ৪ জানুয়ারি। তাঁর বাবার নাম বরদা কান্ত দাস, মা কিরণ বালা দাস। ১৯৬২ সালে তিনি দর্শন বিষয়ে এমএ পাস করে গোপালগঞ্জের কায়েদে আজম মেমোরিয়াল কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। কবিতা আবৃত্তি ও বিপ্লবী গান গেয়ে শিক্ষার্থীসহ মুক্তিপাগল জনতাকে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করতেন। তিনি দর্শন ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে চারটি বই লিখেছেন। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু কলেজে একটি ছাত্রাবাস রয়েছে সন্তোষ কুমার দাসের নামে। বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে সন্তোষ কুমার দাসের জীবনী রয়েছে।
গোপালগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়লে সন্তোষ কুমার সদরের উরফি ইউনিয়নের মানিকহার গ্রামে কাপালিকপাড়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। হানাদার বাহিনী একাত্তরের ৩০ এপ্রিল তাঁর খোঁজে মানিকহার গ্রামে গণহত্যা চালায়। এ গ্রামেই শহীদ হন সন্তোষ দাস। পরে ওই গ্রামে শহীদদের তালিকাসংবলিত একটি ফলক নির্মিত হয়, সেখানেও সন্তোষ দাসের নাম রয়েছে।
সন্তোষ কুমার দাসের স্ত্রী নীলিমা দাসের বয়স প্রায় ৭৫ বছর। ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী মহল্লায় সেমি পাকা একটি টিনের ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর চার ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কঠিন দুর্বিপাকে পড়েন তিনি। এখন বড় ছেলে পলাশ চন্দ্র দাস ফরিদপুরে একটি দোকানের কর্মচারী। দ্বিতীয় ছেলে মিঠু কুমার দাস এলজিইডির কর্মচারী। অপর দুই ছেলে অপু দাস ও বিপ্লব দাস ঢাকায় দোকান কর্মচারীর কাজ করতেন। এখন করোনার কারণে বেকার হয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। মেয়ে শর্মিলা দাসের বিয়ে হয়েছে।
নীলিমা দাস জানান, সন্তোষ কুমারই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হচ্ছে। সে কারণে সন্তানদের বেশি লেখাপড়া করাতে পারেননি। এখনো তাঁর সংসারে ভীষণ অভাব-অনটন। তাঁদের কোনো জমিজমা বা নিজস্ব ঘরবাড়ি নেই।
২০১৯ সালের ২৫ মার্চ ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে এক লিখিত আবেদনে নীলিমা দাস জানিয়েছিলেন, বাসাভাড়া ও অন্যান্য খরচ চালানো তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একটি বাসস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নতুন এসেছেন। বিষয়টি জানেন না। লকডাউন উঠে গেলে পরিবারটির সঙ্গে কথা বলবেন। তাঁদের অবস্থা জেনে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিবারটির জন্য জমিসহ বাসস্থানের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন।
গ্রন্থনা: প্রবীর কান্তি বালা, প্রতিনিধি, ফরিদপুর