বিজ্ঞাপন
default-image

গ্রামের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেবেন বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চাকরি ছেড়ে যশোরে নিজের বাসায় বসে রোগী দেখতেন কাজী ওবায়দুল হক। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে। বিশ্বাস করতেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ–নির্যাতন থেকে বাঙালিকে মুক্ত হতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। স্থানীয় তরুণদের তিনি এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। চিকিৎসার পাশাপাশি অনেক সামাজিক–সাংস্কৃতিক কাজেও যুক্ত ছিলেন এই মানবহিতৈষী চিকিৎসক। হানাদার পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছিল।

শহীদ ওবায়দুল হকের বাড়ি সাতক্ষীরার তালা উপজেলার সরুলিয়া গ্রামে। বাবা শিক্ষা বিভাগের পরিদর্শক কাজী আবদুল্লাহর কর্মস্থল চট্টগ্রামে তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালে। সাত ভাই ও তিনি বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে এখানেই চাকরিতে যোগ দেন। চার বছর পর চাকরি ছেড়ে তিনি যশোরে চলে যান। শহরের এম এম রোডের নিজ বাড়ির চেম্বারে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখা শুরু করেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি রয়েছে বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে।

যশোরে এখন তাঁদের কেউ থাকেন না। সাতক্ষীরার সরুলিয়া গ্রামে ওবায়দুল হকের ষষ্ঠ ভাই কাজী মাশরেকুস সিদ্দিকীন থাকেন। তিনি জানালেন, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে ওবায়দুল হকের স্ত্রী রশীদা বানু মেয়ে শিরিন হোসেন ও ছেলে কাজী আতাউল হককে নিয়ে কানাডায় চলে গেছেন। সেখানেই তাঁরা থাকেন।

মাশরেকুসের মাধ্যমে মেইলে রশীদা বানুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্বামীর স্মৃতিচারণা করে বলেন, স্বাধিকারের দাবিতে যখন দেশ উত্তাল তখন ওবায়দুল হকও আন্দোলনে একাত্ম হয়েছিলেন। তরুণদের নিয়ে তিনি আলোচনায় বসতেন। তাঁদের যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

রশীদা বানু বলেন, ‘একাত্তরের ২৫ মার্চ তাঁরা সবাই যশোরেই ছিলেন। শেষ রাতে যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে আসা গোলাগুলির আওয়াজে সবাই জেগে উঠলাম। একটু পরেই ভোর হয়ে গেল। বাইরে কারফিউ। এভাবে দুই দিন কেটে যায়। আমাদের বাড়ির সামনে পাকিস্তানি সেনারা একজনকে গুলি করে হত্যা করে। ওবায়দুল ভাবছিলেন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী সুলতান আহমদ ছিলেন তাঁর বন্ধু মানুষ। গাড়ি নিয়ে বের হয়ে সপরিবারে তাঁর ক্যাম্পাসের বাসায় আশ্রয় নিলাম।

৫ এপ্রিল দুপুরে খাবারের আয়োজন হচ্ছিল। এমন সময় সাতজন সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনা দরজায় এসে ধাক্কা দিতে শুরু করে। প্রকৌশলী সুলতান আহমদ দরজা খুলে দিয়ে নিজেকে শিক্ষক বলে পরিচয় দেন। কিন্তু ঘাতকেরা তাঁকে মারধর করতে থাকে। নরপশুরা গুলি করে তাঁর শ্যালক ২১ বছরের তরুণ নাজমুল হক ও চিকিৎসক ওবায়দুল হককে হত্যা করে। ঘাতকেরা ওবায়দুল হককে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে তিনি গৌরবের সঙ্গে বলেন, তিনি বাঙালি। সঙ্গে সঙ্গে ওরা তাঁকে গুলি করে।’

কাজী মাশরেকুস সিদ্দিকীন জানান, পৈতৃক ভিটায় ওবায়দুল হকের স্মরণে একটা হাসপাতাল করার ইচ্ছা রয়েছে। তবে এ জন্য তাঁরা সরকারি সহায়তা প্রত্যাশা করেন।

গ্রন্থনা: কল্যাণ ব্যানার্জি, নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা