বিজ্ঞাপন
default-image

প্রতিদিনের মতো একাত্তরের ২৬ জুলাই রাতে তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে সাংবাদিক মোহাম্মদ আলি ও মনোয়ারা বেগম দম্পতি ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁদের মাটির ঘরে। মধ্যরাতে বাড়ির পাশের রাস্তায় গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় মনোয়ারার। ডেকে তোলেন স্বামী মোহাম্মদ আলিকে।

খানিক বাদেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে শিশুসন্তানদেরও ঘুম ভেঙে যায়। দরজার বাইরে থেকে কর্কশ কণ্ঠে উর্দুতে দরজা খোলার হুকুম দেয় এক পাকিস্তানি হানাদার সেনা।

কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না মোহাম্মদ-মনোয়ারা দম্পতি। এরই মধ্যে লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে হানাদার সেনারা। স্ত্রী ও শিশুসন্তানদের সামনেই টেনেহিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে মোহাম্মদ আলিকে। তাঁর দুই হাত পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে গাড়িতে তোলে।

হানাদার সেনাদের দলপতি মনোয়ারা বেগমকে বলেছিল, চিন্তার কোনো কারণ নেই। জিজ্ঞাসাবাদ করে মোহাম্মদ আলিকে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু কথা রাখেনি ঘাতকের দল। মোহাম্মদ আলিকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে বন্দী করে তাদের নির্যাতন কেন্দ্রে। অমানুষিক নির্যাতন করে পরদিন ২৭ জুলাই তাঁকে হত্যা করে তাঁর লাশ গুম করে ফেলে।

শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলির একমাত্র ছেলে কবির মোহাম্মদ শহীদুল হাসান গত বৃহস্পতিবার তাঁদের চুয়াডাঙ্গা শহরের জ্বীনতলা মল্লিকপাড়ার বাসায় প্রথম আলোকে এই বর্ণনা দেন। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল আড়াই বছর। তিনি জানান, তাঁর স্কুলশিক্ষক মা মনোয়ারা বেগম এবং বাবার সহকর্মীদের কাছ থেকে বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার এই বিবরণ জেনেছেন। তাঁর বড় বোন রেহেনা খাতুনের বয়স ছিল পাঁচ বছর এবং ছোট বোন শিরিনা খাতুনের বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস।

বাংলা একাডেমির রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি: ১৯৭১-এর পুনর্বিন্যাসকৃত তৃতীয় খণ্ডে চুয়াডাঙ্গার স্টুডিও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ‘আমার বন্ধু’ শিরোনামে শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলি সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, মোহাম্মদ আলি ছিলেন খুবই শান্তশিষ্ট স্বভাবের ও মৃদুভাষী মানুষ। স্নাতক শ্রেণিতে পড়ালেখার সময় মোহাম্মদ আলি ইংরেজি দৈনিক অবজারভার-এর চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দেন। পরে কাজ করেন দৈনিক সংবাদ-এ।

মোহাম্মদ আলির জন্ম ১৯৩৯ সালে চুয়াডাঙ্গা শহরে। তাঁর বাবা মোহাম্মদ শামছুদ্দীন কৃষিজীবী, মা সুফিয়া বেগম। পাকিস্তান আমলে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) চুয়াডাঙ্গা মহকুমা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতির সূত্রেই মোহাম্মদ আলি সে সময়ে দেশের প্রথিতযশা প্রগতিশীল ও বামপন্থী রাজনীতিবিদদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মোহাম্মদ আলি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকারদের নজরে পড়ে যান। প্রতিকূলতার মুখে একসময় তিনি শ্বশুরবাড়ি আলমডাঙ্গা উপজেলার জাহাপুরে চলে যান। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছিলেন। একপর্যায়ে মোহাম্মদ আলির পরিচিত শান্তি কমিটির এক নেতা জাহাপুরে গিয়ে তাঁকে চুয়াডাঙ্গায় ফিরে আসতে আশ্বস্ত করেন। তার ওপর বিশ্বাস রেখে মোহাম্মদ আলি চুয়াডাঙ্গায় ফিরে আসেন।

পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম মোহাম্মদ আলিকে হত্যার পর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম সন্তানদের নিয়ে প্রচণ্ড সংকটে পড়েন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি এসএসসি পাস করেন ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। নানান দুশ্চিন্তা আর অসুখে ভুগে ১৯৭৮ সালে তিনি তিন শিশুসন্তানকে রেখে মারা যান। সন্তানদের আশ্রয় হয় নানার বাড়ি জাহাপুরে। সেখান থেকেই পরবর্তী সময়ে তাঁদের লেখাপড়া ও বিয়েশাদি হয়।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে স্বজন ও সহকর্মীদের আক্ষেপ ,এত দিনেও শহীদ সাংবাদিক মোহাম্মদ আলি কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না। সরকারিভাবে তিনি অন্তত শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পান, এটাই তাঁদের প্রত্যাশা।

গ্রন্থনা: শাহ আলম, চুয়াডাঙ্গা