বিজ্ঞাপন
default-image

শিক্ষকতা করতেন মো. খবিরউদ্দিন মিয়া। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুবকদের সংগঠিত করেন। বিদ্যালয় মাঠে বাঁশের লাঠি ও কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর পাংশা থেকে রাজাকাররা তাঁকে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরিয়ে দেয়। তারপর আর খবিরউদ্দিন মিয়ার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

শহীদ খবিরউদ্দিন মিয়ার জন্ম ১৯২৮ সালে রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের রায়নগর গ্রামে। ছোটবেলায় মা-বাবা হারান। নানাবাড়ি বালিয়াকান্দি উপজেলার শামুকখোলা গ্রামেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ১৯৫৪ সালে রামদিয়া বিএমবিসি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তিনি বিয়ে করেন সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের হাটবাড়িয়া গ্রামে। এখানেই ১৯৫৪ সালে তিনি বেলগাছি আলিমুজ্জামান বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন (বর্তমানে এটি বেলগাছি আলিমুজ্জামান স্কুল অ্যান্ড কলেজ)।

মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে খবিরউদ্দিন মিয়া স্থানীয় যুবক-তরুণদের সংগঠিত করেন। স্কুল মাঠে বাঁশের লাঠি ও কাঠের বন্দুক দিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি রাজাকারের দলে যোগ দিয়েছিল। তাদের সঙ্গে বৈরিতা ছিল স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক খবিরউদ্দিনের। এরাই খবিরউদ্দিনকে ধরিয়ে দেয় বলে তাঁর পরিবার জানায়। বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে।

খবিরউদ্দিন মিয়া তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে রেখে গিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী ছালেহা বেগম জীবিত। বড় ছেলে মারা গেছেন, তিনি শিক্ষকতা করতেন। মেজ ছেলে আবদুর রব মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন। একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর পাংশায় সরকারের তরফ থেকে বীজ দেওয়ার কথা ছিল। বাবা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বীজ আনতে যান।

তখন সময় সকাল সাড়ে নয়টা। মেজ ছেলেকে নিয়ে পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটাপথে রওনা দেন খবিরউদ্দিন। এলাকার আরও আট-দশজন তাঁদের সঙ্গে বীজ আনতে যাচ্ছিলেন। গতমপুর বাজার এলাকায় পৌঁছার পর কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র তাঁদের পাংশা যেতে নিষেধ করেন। খবিরউদ্দিন ফিরে না গিয়ে পাংশার দিকে যেতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাঁরা পাংশা রেলস্টেশনে পৌঁছান। এলাকা ছিল সুনসান নীরব। খবিরউদ্দিন তাঁদের একটা চায়ের দোকানে বসিয়ে শহরের দিকে যান। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি।

বিকেল চারটার দিকে চায়ের দোকানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রব মিয়া তখন বাবাকে খুঁজতে থাকেন। এক আত্মীয়ের কাছে জানতে পারেন পাংশা রেলস্টেশন থেকে পাকিস্তানি ঘাতক সেনারা তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। রাজাকাররা তাঁকে ধরিয়ে দেয়। এরপর আর তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

খবিরউদ্দিনের স্ত্রী ছালেহা বেগম বলেন, ‘রাজাকাররা আমার স্বামীকে ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি কখনো কারও ক্ষতি করেন নাই। খুব আশা নিয়ে থাকতাম। এই বুঝি তিনি হাসিমুখে বাড়ি ফিরে আসবেন। কিন্তু ফিরে এলেন না। অনেক কষ্টে সন্তানদের বড় করেছি। তাদের মুখে ঠিকমতো খাবার দিতে পারিনি। আমরা কখনো কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি।’

গ্রন্থনা: এজাজ আহম্মেদ, প্রতিনিধি, রাজবাড়ী