বিজ্ঞাপন
default-image

মাগুরা শহরঘেঁষা নবগঙ্গা নদীতে ভাসছিল মুন্সী মুজিবর রহমানের লাশ। কিন্তু তাঁকে তুলে এনে দাফন করার সাহস কারও ছিল না। রাজাকার আর পাকিস্তানি হানাদার সেনারা ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিল এলাকায়। মাগুরার এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষানুরাগীর পরিবার এখনো এই মর্মবেদনা ভুলতে পারে না।

শহীদ মুন্সী মুজিবর রহমানের স্ত্রী অশীতিপর মরিয়ম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জীবনের সবচেয়ে দুঃসময় ছিল একাত্তরের ১৫ আগস্ট। ওই দিন নবগঙ্গা নদীর ভাটিতে আমার স্বামীর মৃতদেহ ভেসে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু রাজাকাররা নদী থেকে মৃতদেহ তুলে আনতে দেয়নি। সেই বেদনা আজও মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি।’

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক জাহিদ রহমান শহীদ মুজিবর রহমানের ছবি ও তথ্য পাঠান। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়। মুন্সী মুজিবর রহমানের জন্ম ১৯২৫ সালে, মাগুরা সদর উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নে। বাবা মুন্সী আবদুল হাকিম ও মা রহিমা খাতুন। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। মুন্সী মুজিবর এলাকায় সাংস্কৃতিক সংগঠক ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি এলাকায় হাজীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। আমৃত্যু তিনি এই বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই এলাকায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। ভালো ফুটবলও খেলতেন। অনেক সমাজসেবামূলক কাজ করেছেন। মুন্সী মুজিবর ১৯৪৪ সালে শ্রীপুরের নাকোল রায়চরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলেন কুষ্টিয়া কলেজে। পাস করার আগেই মাগুরা ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়ার লেখা আমি ও আমার বাহিনী এবং মাগুরার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক জাহিদ রহমানের লেখা মুক্তিযুদ্ধে মাগুরার শত শহীদ বইয়ে মুন্সী মুজিবর রহমানের জীবনী ও ভূমিকা রয়েছে।

মুজিবরের চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বড় আইনজীবী লুৎফুল হাকিম নওরোজ জানান, একাত্তরের ১৩ আগস্ট তাঁর বাবাকে মাগুরা জজকোর্টের পাশের ভূমি অফিস থেকে রাজাকাররা তুলে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি। পরে তাঁরা জানতে পারেন, ওই দিন রাতেই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে শহরের অদূরে পারনান্দুয়ালী ডাইভারশন ক্যানেলের পাশে লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে। দুই দিন পর ১৫ আগস্ট শহরঘেঁষা নবগঙ্গা নদীতে তাঁর লাশ ভাসতে দেখা যায়।

লুৎফুল জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মায়ের কাছে সমবেদনা প্রকাশ করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দুই হাজার টাকা পাঠানো হয়েছিল। তাঁর বাবাকে হত্যার দায়ে ১৯৭২ সালে তাঁর মা কুখ্যাত রাজাকার আইয়ুব চৌধুরী, রিজু, কবীরসহ অন্যদের নামে একটি হত্যা মামলা করেছিলেন। বেশ কয়েকবার শুনানিও হয়। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।

গ্রন্থনা: কাজী আশিক রহমান, মাগুরা