‘গরিবের চিকিৎসক’ বলে খ্যাতি ছিল নেত্রকোনার মিহির কুমার সেনের। রাজনীতিসচেতন ও সংস্কৃতিমান মানুষ ছিলেন তিনি। নেত্রকোনা শহরের মোক্তারপাড়ায় বেশ বড় পৈতৃকবাড়ি তাঁর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকের মতো তাঁরাও শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি কাইলাটিতে গিয়ে ওঠেন। একদিন খবর পান তাঁদের শহরের বাড়িটি রাজাকাররা দখলের চেষ্টা করছে। এরপর মিহির সেন তাঁর দুই শ্যালক সিদ্ধার্থ সেন, শঙ্কর সেন ও পারিবারিক কর্মচারী করুণা দেকে নিয়ে শহরের দিকে রওনা দেন। সেদিন ছিল একাত্তরের ২৯ এপ্রিল।
মিহির সেনদের ভাগ্য মন্দ। মগড়া নদী পেরিয়ে জেলা প্রশাসকের বাসভবনের পাশ দিয়ে তাঁরা শহরে ঢুকেছেন। সূর্য তখন অস্ত যায় যায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও ঠিক তখনই প্রবেশ করছিল নেত্রকোনা শহরে। হানাদারদের অভ্যর্থনা জানাতে স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষকের নেতৃত্বে রাজাকারের দল অপেক্ষা করছিল সেখানে। মিহির সেন পড়ে গেলেন হানাদারদের সামনে। অভ্যর্থনাকারীদের ইঙ্গিতে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের চারজনকে আটক করে সাঁজোয়া গাড়িতে তুলে নেয়। পরে প্রচণ্ড নির্যাতন চালিয়ে রাতে পূর্বধলার ত্রিমোহনী সেতুর নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। মিহির সেন, সিদ্ধার্থ সেন ও করুণা দে মারা গেলেও শঙ্কর সেন আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সোনালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও জেলা উদীচীর সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান খান প্রথম আলোকে
জানান, ঘটনার পরদিন বিকেলে নদীতে ভাসতে থাকা মৃতপ্রায় শঙ্করকে তিনি কয়েকজনের সহায়তায় তুলে আনেন। তাঁর হাতে ও বুকে
গুলি লেগেছিল। স্থানীয় এক চিকিৎসকের সহায়তায় গুলি বের করা হয়। এরপর তিনি আট বছর বেঁচে ছিলেন।
মিহির কুমার সেনের জন্ম ১৯৩৬ সালে। তাঁর বাবা হেমচন্দ্র সেন ছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী। মা সাধনাময়ী সেনগুপ্ত। মিহির সেন নেত্রকোনা দত্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ময়মনসিংহ লিটন কলেজ থেকে এলএমএফ পাস করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সহকারী সার্জন ছিলেন। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছেন। বড় মেয়ে কবিতা সেনগুপ্ত মালয়েশিয়ায় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ছোট মেয়ে রুমা সেনগুপ্ত গৃহিণী। ছেলে পিনাকী সেন ও ধৃতব্রত সেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থে চিকিৎসকদের তালিকায় এবং আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে মিহির সেনের জীবনী রয়েছে।
মিহির সেনের স্ত্রী কৃষ্ণা সেনগুপ্ত জানান, রাজাকাররা তাঁদের পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। মিহির সেনকে হত্যার পর তাঁর বাবা হেমচন্দ্র সেন ও জ্যাঠা অখিল চন্দ্র সেনকেও তারা হত্যা করে। সেই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সন্তানদের নিয়ে তিনি ভারতে শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে নেত্রকোনায় ফিরে কঠিন সংগ্রাম করে সন্তানদের বড় করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পান। ওই চিঠিতে বঙ্গবন্ধু সমবেদনা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে তাঁদের পরিবারের জন্য মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা পাঠান।
গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা।