বিজ্ঞাপন
default-image

নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক মন্মথ নাথ রায় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ হন। তাঁর ছাত্র ও তরুণদেরও সংগঠিত করতে থাকেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একাত্তরের ১৪ সেপ্টেম্বর সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন মন্মথ রায় ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা। মন্মথকে প্রচণ্ড নির্যাতন করে জীবন্ত অবস্থায় একটি পানি ভরা কূপে ফেলে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি সেনার দল।

শহীদ মন্মথ নাথ রায়ের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা জানান নওগাঁর স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা-আল-মেহমুদ। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে তিনি মন্মথ নাথ রায়ের তথ্য ও ছবি পাঠান। নওগাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণার ভিত্তিতে তাঁর রক্তঋণ ১৯৭১: নওগাঁ বইয়ে মন্মথ নাথের জীবনী রয়েছে।

মন্মথ নাথ রায়ের স্বজন ও সহযোদ্ধারা জানান, মন্মথ নাথ রায় ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে নওগাঁর সীমান্তবর্তী সাপাহার ও পত্নীতলা উপজেলায় বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। সর্বশেষ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল সাপাহার উপজেলা সদরে।

শহীদ মন্মথ রায়ের সহযোদ্ধা রাধা বল্লভ বলেন, ‘একাত্তরের ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে আমরা ৫০-৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে চারপাশ থেকে সাপাহারে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে আক্রমণ করি। রাতভর যুদ্ধে ঘটনাস্থলে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিস্তানি সেনারাও ব্যাপক হতাহত হয়। পরদিন সকালে মহাদেবপুর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি দল এসে যুদ্ধে যোগদিলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছুহটে যায়।

মন্মথ নাথের দলটি সাপাহার কলেজপাড়ার একটি বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তাঁরা দুপুরে খাবারের সময় হানাদার সেনাদের আক্রমণের শিকার
হয়। তাঁরা খাবার ফেলে পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকেন। ঘটনাস্থলে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং মন্মথ নাথ রায়সহ ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানিদের হাতে আটক হন। পরে তাঁদের মধ্যে পাঁচজনকে পত্নীতলার মধইল এলাকার স্কুলের ছাদে তুলে হানাদারেরা হত্যা করে এবং দলনেতা মন্মথ রায়কে মহাদেবপুর সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নির্যাতন করে গুরুতর আহত অবস্থায় একটি পানি ভরা কূপে ফেলে দেয়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।’

মন্মথ নাথ রায়ের জন্ম ১৯৪৪ সালে তৎকালীন নওগাঁ মহকুমার সদর থানার সালেবাজ গ্রামে। বাবা কর্ণধার রায় ও মাতা পঞ্চ রানী রায়। নওগাঁর বাচাড়িগ্রাম হাইস্কুল, সাপাহারের বটতলী ও বামইন হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। স্ত্রী কুমুদ কামিনী রায় ও মেয়ে পার্বতী রায়কে রেখে শহীদ হন। সাপাহার উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত শহীদ স্মৃতিসৌধে শহীদ শিক্ষক মন্মথ নাথ রায়ের নাম উৎকীর্ণ রয়েছে।

মন্মথ রায়ের স্ত্রী বয়সের কারণে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তাঁর মেয়ে পার্বতী রায় গৃহিনী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল এক বছর। মা ও তাঁকে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার দালালহাট এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে বাবা বালুরঘাটে প্রশিক্ষণ নিতে যান। পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বাবার সঙ্গে তাঁদের আর দেখা হয়নি। পার্বতী রায় বলেন, ‘আমরা বাবার লাশের হদিস পাইনি। তবে বাবার নাম মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বেসামরিক শহীদদের গেজেটে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মা এখনো মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ভাতা পাচ্ছেন।’

গ্রন্থনা: ওমর ফারুক, নওগাঁ