একাত্তরের এপ্রিলের প্রথম ভাগে রাজশাহীসহ আশপাশের উপজেলা শহরগুলোতে অবস্থান নেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাদের উপস্থিতি, বন্দুকের গুলি আর বুটের শব্দে আতঙ্কিত মানুষ তখন ছুটছিল নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী সার্জন মনসুর রহমান সরকার তখনো রোগী দেখছিলেন। হানাদার সেনাদের হাতে নির্যাতিতদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। থাকতেন হাসপাতালের আবাসিক এলাকার বাসভবনে।
মনসুর রহমানের সঙ্গে হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন চিরিরবন্দর এলাকার নজিবর রহমানের মেয়ে চিকিৎসক মমজিলা খাতুন। তাঁরা একসঙ্গে পড়াশোনা শেষ করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন। মমজিলার বাবা নজিবর রহমান কর্মরত ছিলেন রাজশাহীর রেজিস্ট্রার হিসেবে। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই লক্ষ্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাঁরা ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ১৩ এপ্রিল সকালে মনসুর রহমান, মমজিলা খাতুন ও তাঁর বাবা নজিবর রহমান চারঘাট উপজেলার দিকে পায়ে হেঁটে রওনা দেন। রাজাকাররা তাঁদের ওপর নজর রাখছিল। পথে তাঁদের দেখে হানাদার বাহিনীকে খবর দেয়। তৎকালীন চারঘাট এলাকার সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি হন তাঁরা। ঘাতক সেনারা রাস্তার ওপরই মনসুর রহমান ও নজিবর রহমানকে গুলি করে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে চলে যায়।
চোখের সামনে বাবা ও সহকর্মীর মৃত্যুতে চিকিৎসক মমজিলা খাতুন শোকে বিহ্বল হয় পড়েন। পরে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় তাঁদের মরদেহ চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশেই মাটিচাপা দেওয়া হয়। এরপর মমজিলা চিরিরবন্দরের বাসুদেবপুরে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন।
শহীদ চিকিৎসক মনসুর রহমান সরকারের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার আবদুলপুর ইউনিয়নের নান্দেরাই গ্রামে। তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৯ জানুয়ারি। এলাকায় পরিচিত ছিলেন মন্টু নামে। বাবা ফজলুল হক সরকার ও মা বিবিজান। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মনসুর রহমান সর্বকনিষ্ঠ। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে পরের বছর সেখানেই চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। তিনি বিয়ে করেননি।
গত শুক্রবার নান্দেরাই গ্রামে শহীদ মনসুরের বাড়িতে গেলে কথা হয় তাঁর ভাতিজা মোত্তালেব সরকারের সঙ্গে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, চাচার বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছিল। এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে বিয়ে পিছিয়ে যায়। তিনি নিয়মিত বাড়িতে চিঠি লিখে পরিবারের খোঁজ নিতেন। এলাকায় হাসপাতাল তৈরির স্বপ্ন ছিল তাঁর। গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেওয়ার কথা ভাবতেন।
সাহিত্য প্রকাশের বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ বইয়ে এবং আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ-এ মনসুর রহমানের জীবনী রয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে স্থাপিত শহীদ চিকিৎসকদের স্মৃতিফলকে তাঁর নাম রয়েছে।
স্বজনেরা বাড়ির পাশে ১৯৯৯ সালে ‘শহীদ ডা. মনসুর রহমান সরকার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান করে সমাজসেবামূলক কাজ করছেন। নিজেদের অর্থায়নে এখন ২০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। তাঁর ভাতিজা ওষুধ ব্যবসায়ী আবদুল মোত্তালেব জানান, আপাতত সপ্তাহে তিন দিন বিনা মূল্যে দুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গ্রন্থনা: রাজিউল ইসলাম, দিনাজপুর