বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ১৬ মে দুপুরের কথা। গৌরীপুরের শালীহর গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে মুক্তিকামী এক শিক্ষককে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত লোকালয় থেকে অনেক নির্বাক মানুষ সে দৃশ্য দেখছিলেন। এ ঘটনার ৫০ বছর পরও গ্রামের মানুষের স্মৃতিতে দৃশ্যটি তরতাজা হয়ে ভেসে আসে।

ময়মনসিংহের ওই গ্রাম থেকে হানাদার সেনারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল শিক্ষক মধুসূদন ধরকে। তিনি ছিলেন গৌরীপুর আর কে হাইস্কুলের শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। খেলাধুলায় প্রবল আগ্রহ ছিল। ভালো ফুটবল খেলতেন, একসময় রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন।

মধুসূদন ধরের জন্মসাল জানা যায় না। বাবা যোগেশ চন্দ্র ধর। শৈশব কেটেছে জামালপুরের নান্দিনায়। সেখান থেকেই মাধ্যমিক পাস করে ১৯৪২ সালে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকের সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি।

মধুসূদন ধরের স্ত্রী কমলা ধর জীবিত নেই। বড় ছেলে সুপ্রিয় ধর, বড় মেয়ে সুপ্রিয়া ধর গৌরীপুরে থাকেন। ছোট ছেলে সুব্রত শংকর ধর যুক্তরাষ্ট্র ও ছোট মেয়ে সুপ্রীতি ধর সুইডেনপ্রবাসী। বড় ছেলে জানান, তাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছিলেন। সে কারণে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীরা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা শুরু করলে শহর থেকে বহু মানুষ তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৫ এপ্রিল রাতে তাঁদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। গ্রামের লোক দল বেঁধে ডাকাতদের প্রতিরোধ করে এক ডাকাতকে ধরেও ফেলে। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

১৬ মে একদল পাকিস্তানি সেনা বিশেষ ট্রেনে গৌরীপুর এসে মধুসূদনকে আটক করলে গ্রামের বহু মানুষ তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। মধুসূদন ধর বুঝতে পেরেছিলেন তাঁকে নিয়ে যেতে না পারলে হানাদাররা পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। তিনি গ্রামবাসীকে শান্ত করে হানাদার সেনাদের সঙ্গে চলে যান। অসংখ্য মানুষ পথের দুই পাশে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখেন।

মধুসূদন ধর আর ফিরে আসেননি। সুপ্রিয় বলেন, ‘বাবাকে নিয়ে যাওয়া ট্রেনটি ভৈরবের দিকে যায়। পরে জানতে পারি, ওই রেলপথের মুসল্লি সেতুর নিচে সেনারা অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। স্বাধীনতার পর মুসল্লি গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, বাবাকেও ওখানে হত্যা করা হয়েছে। বাবার গায়ের শার্ট আর আংটির বর্ণনা শুনে আমার এমনটাই মনে হয়েছে।’ তিনি জানান, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের পরিবারের কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকার অনুদান দিয়েছিলেন।

গৌরীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ বলেন, ‘মধুসূদন ধরের স্মৃতি রক্ষায় স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম রাখা হয়েছে শহীদ মধুসূদন ধর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে তাঁর নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সরকারি তালিকায় নেই। আমরা চাই, পরিবারটি শহীদ পরিবারের মর্যাদা পাক।’

গ্রন্থনা: কামরান পারভেজ, ময়মনসিংহ