বিজ্ঞাপন
default-image

গ্রামের এক বাড়িতে সালিস বৈঠক করছিলেন মণিভূষণ চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। এলাকায় ন্যায়বিচার ও সমাজকল্যাণকর কাজের জন্য খুব জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তরুণদের সংগঠিত করছিলেন যুদ্ধে যেতে। রাজাকাররা হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে এসে ওই বৈঠক থেকে মণিভূষণসহ পাঁচজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

শহীদ মণিভূষণ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯২৭ সালে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়নের উত্তর ভাট শহর গ্রামের হিন্দুপাড়ায়। বাবা খিরিদচন্দ্র চক্রবর্তী। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মানুষটি এলাকায় সামাজিক বিচার-আচার, সালিস-দরবারে অত্যন্ত পক্ষপাতহীন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে মীমাংসা করতেন বলে এলাকায় খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে বাংলা একাডেমি ও আগামী প্রকাশনীর দুটি শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে। তাঁকে সমাজসেবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

উত্তর ভাট শহর গ্রামে মণিভূষণ চক্রবর্তীর কোনো জমিজমা নেই। শুধু বসতভিটে রয়েছে। সেখানে কেউই থাকেন না। মণিভূষণ চক্রবর্তীর স্ত্রী রেবা রানী চক্রবর্তীর বয়স আশির কাছাকাছি, শয্যাশায়ী। তাঁদের দুই ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলে ভানুভূষণ চক্রবর্তী দিনাজপুরে ঘোড়াঘাটের রানীগঞ্জে থাকেন। বড় মেয়ে মিরা রানী চক্রবর্তী অনেক আগেই মারা গেছেন, ছোট মেয়ে দীপ্তি রানী চক্রবর্তীর বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে মিলন চক্রবর্তী তাঁর মাকে নিয়ে জয়পুরহাট শহরে থাকেন। তিনি সবজি বিক্রি করে সংসার চালান। তাঁদের খুব অভাব-অনটনের সংসার।

মণিভূষণ চক্রবর্তীর ভাতিজা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, সমাজকল্যাণমূলক কাজ ও ন্যায়বিচারের জন্য এলাকায় তাঁর কাকার জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। এলাকার লোকজনকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সংগঠিত করছিলেন বলে রাজাকাররা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। একাত্তরের ২৪ মে বিকেলে মণিভূষণ চক্রবর্তী নিজ গ্রামে একটি সালিস বৈঠকে বসেছিলেন। ওই সালিস বৈঠকে গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক তখন শেষের দিকে। এমন সময় স্থানীয় রাজাকাররা হানাদার সেনাদের নিয়ে এসে বাড়িটি ঘিরে ফেলে। তারা সালিস বৈঠক থেকে ইউপি সদস্য মণিভূষণ চক্রবর্তী, প্রভাষ চন্দ্র শীল, প্রিয়নাথ বর্মণ, কার্তিক চন্দ্র বর্মণ ও নিমাই চন্দ্র বর্মণকে তুলে নেয়। হানাদাররা তাঁদের ক্ষেতলাল থানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।

দিলীপ কুমার জানান, তিনি তাঁদের পিছু পিছু কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসেন। সালিস থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর ২৭ মে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা মণিভূষণ চক্রবর্তীসহ পাঁচজনকে স্থানীয় কুঠিবাড়ি সেতুর কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মৃতদেহগুলো সেখানেই কোথাও তারা মাটিচাপা দেয়। পরে আর তাঁদের মৃতদেহগুলো পাওয়া যায়নি।

মণিভূষণ চক্রবর্তীর বড় ছেলে ভানুভূষণ চক্রবর্তী জানান, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বাবা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি বা সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা তাঁরা পাননি।

গ্রন্থনা: রবিউল ইসলাম, প্রতিনিধি, জয়পুরহাট