বিজ্ঞাপন
default-image

দেশে তখন পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধ। অন্যদের মতো প্রকৌশলী বাদশা আলম সিকদারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যুদ্ধে যাওয়ার। তাঁর স্ত্রী তখন প্রথম সন্তানসম্ভবা। কিন্তু সন্তানের মুখ দেখার আগেই হানাদার সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁকে।

শহীদ বাদশা আলম সিকদার একাত্তরে ছিলেন তাঁর সর্বশেষ কর্মক্ষেত্র গাইবান্ধার সিঅ্যান্ডবির বিভাগীয় প্রকৌশলী। এখানেই সরকারি বাসভবনে সস্ত্রীক থাকতেন। পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে উঠলে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মেহেরুন্নেসাকে পাঠিয়ে দেন সিলেটে তাঁর মা-বাবার কাছে।

বাদশা আলমের স্মৃতিচারণা করে তাঁর বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক শামীম সিকদারের একটি লেখা রয়েছে রশীদ হায়দার সম্পাদিত বাংলা একাডেমির স্মৃতি ১৯৭১-এর পুনর্বিন্যাসকৃত দ্বিতীয় খণ্ডে। তিনি লিখেছেন, ‘যুদ্ধের রক্ত গায়ে মেখে যার জন্ম, যুদ্ধের গন্ধ যার শরীরে; সেই যুদ্ধ শেষ হবে, স্বাধীন হবে বাংলা। সেই মেয়ে দেখবে স্বাধীনতার মুখ, মুক্ত আকাশে সবুজের মাঝে লাল সূর্য আঁকা পতাকা ধরে ঐ ছোট মেয়েটি বলবে—বাবা আমি স্বাধীন। সেই বাবা বলার আগেই পাকসেনারা আমার বড় ভাইকে ২৫ এপ্রিল বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। তাঁর বাবুর্চি ও অন্যান্য অসংখ্য বুদ্ধিজীবীসহ তাঁকে রংপুরে ব্রিজের নিচে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর লাশ আর কোনো দিন পাইনি।’ আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থেও তাঁর জীবনী রয়েছে।

বাদশা আলমের জন্ম শরীয়তপুরের লাকার্তা গ্রামের সিকদারবাড়িতে। তাঁর বাবা আবদুর রাজ্জাক সিকদার সরকারি কর্মকর্তা। মা বেলাতুন নেছা গৃহিণী। বাদশা আলম পটুয়াখালীর জুবিলী স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও বরিশাল বিএম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট ব্যাচ ৬৩) ভর্তি হন। কৃতিত্বের সঙ্গে পুরপ্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে সিঅ্যান্ডবিতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর ছোট ভাই পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির কমরেড সিরাজ শিকদারও বুয়েটের পুরপ্রকৌশলে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। তাঁদের তৃতীয় ভাই নূরুল হক সিকদারও প্রকৌশলী। তিনি লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। চতুর্থ ভাই নাজমুল হক সিকদার চিকিৎসক। পঞ্চম ভাই মনজুরুল হক সিকদার ও ষষ্ঠ ভাই শহিদুল হক সিকদার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বাদশা আলমের স্ত্রী মেহেরুন্নেসা ও কন্যা কান্তা সিকদার কানাডাপ্রবাসী।

শহীদুল হক দুঃখ করে বলেন, ‘দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতা ও প্রতিহিংসার কারণে আমাদের পরিবারের কারও কোনো স্বীকৃতি নেই। শহীদ বাদশা সিকদার সরকারি স্বীকৃতি পাননি। কোথাও তাঁর নাম উচ্চারণ করা হয় না। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবারের অনেক অবদান রয়েছে। বাবা একাত্তরে লৌহজং সার্কেলের রেভিনিউ কর্মকর্তা ছিলেন। লৌহজং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। আরেক ভাই সিরাজ শিকদার বরিশালের বিখ্যাত পেয়ারাবাগান যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। সেখানে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছেন। কোথাও তাঁদের স্মরণে কিছু করা হয়নি, তাঁদের কথা বলা হয় না, এটাই আমাদের কাছে আক্ষেপের বিষয়।’

গ্রন্থনা: সত্যজিৎ ঘোষ, শরীয়তপুর