বিজ্ঞাপন
default-image

চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) আবাসিক এলাকার বাসায় থাকতেন চিকিৎসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তিনি কর্মরত ছিলেন করাচি ও লাহোরে। চট্টগ্রাম সিএমএইচে বদলি হয়ে আসেন ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে।

হাসপাতালের বাসায় থেকে রোগীর সেবা দিতেন বদিউল আলম চৌধুরী। স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা তখন পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের বিরুদ্ধে যাঁর যাঁর মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া আহত পুলিশ সদস্যসহ অন্যদেরও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন বদিউল আলম। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এপ্রিলের প্রথম দিকে সেনাবাহিনীর কয়েকজন বাঙালি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বদিউল আলমের সঙ্গে তাঁর সিএমএইচের বাসায় বৈঠক করেন। গোপন এই বৈঠকের খবর পৌঁছে যায় পাকিস্তানি সেনাদের কাছে। এই বৈঠকই কাল হলো তাঁর জন্য। তাঁকেসহ সেই সময় সিএমএইচে কর্মরত ১৬ জন জুনিয়র বাঙালি চিকিৎসককে নিজ নিজ বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ১৭ এপ্রিল রাতে বদিউল আলমকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। এরপর হত্যা করা হলেও সুনির্দিষ্ট তারিখ জানা যায়নি।

শহীদ বদিউল আলমের জন্ম ১৯২১ সালের ২১ এপ্রিল দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শীতলাই গ্রামে। বাবা বশির উদ্দিন চৌধুরী, মা রহিমুন্নেছা চৌধুরী। তিনি এমবিবিএস পাস করেন কলকাতা থেকে। তাঁর ছোট ছেলে তানভীর আহমেদ চৌধুরী (৬০) গত সপ্তাহে শীতলাই গ্রামের বাড়িতে প্রথম আলোর কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও বাবা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৩।

তানভীর বলেন, ‘মা-বাবা আর আমরা দুই ভাই, দুই বোন মিলে আমাদের সংসার। মা, বড় ভাই মুজাহিদ চৌধুরী ও বড় বোন জিনাত চৌধুরী তখন ঢাকায় ছিলেন। বাবাকে আটকের রাতে আমরা ঘরের মেঝেতে বসে ভাত খাচ্ছিলাম। বাবার খাওয়া তখনো শেষ হয়নি। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। দরজা খুলেছিলেন ছোট বোন সাদিয়া চৌধুরী। ছয়-সাত জন মিলিটারি ছিল। তাদের একজন বাবাকে বলছিল, “হামলোক চলে গা।” বাবা বললেন, “আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন?” মিলিটারিরা বাবার কথার উত্তর না দিয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলে। একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বাবা তাদের সঙ্গে চলে যান। যাওয়ার সময় আমাদের বলে যান, “তোমরা থাকো, আমি আসতেছি, চিন্তা করিও না।” কিন্তু বাবা আর ফিরে আসেনি।’

তানভীর জানান, চট্টগ্রাম সিএমএইচে তাঁদের বাসার সবকিছু হানাদার সেনারা লুট করে নিয়ে যায়। ১৯৮২ সালে তানভীর চৌধুরী বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। পরে পাইলট হয়ে অবসর নিয়ে বীরগঞ্জের শীতলাই গ্রামে বসবাস করছেন। তাঁর মা মাহমুদা বেগম ১৯৮৬ সালে ইন্তেকাল করেন। বড় ভাই পেশায় স্থপতি, ঢাকায় থাকেন। বড় বোন চিকিৎসক, ছোট বোন গৃহিণী। দুজনেই কানাডাপ্রবাসী।

চলিত বছর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রজ্ঞাপনে শহীদ চিকিৎসক লে. কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরীর নাম রয়েছে। চট্টগ্রাম সিএমএইচে একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে। এ ছাড়া ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রদর্শনকক্ষের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিদর্শনের গ্যালারিতে তাঁর ব্যবহৃত জায়নামাজ, চশমা, টুপি ও কলম সংরক্ষণ করা হয়েছে।

গ্রন্থনা: রাজিউল ইসলাম, দিনাজপুর।