বিজ্ঞাপন
default-image

বিএ পাস করেই একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন নেত্রকোনা সদর উপজেলার নরেন্দ্রনগর গ্রামের বদিউজ্জামান মুক্তা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সরাসরি এতে অংশ নেন।

একাত্তরের ১৪ নভেম্বর বদিউজ্জামান ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিরামপুর বাজারে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় এলাকার মুখচেনা রাজাকার-আলবদরের দল তাঁদের মধ্য থেকে ছয়জনকে আটক করে। তুলে দেয় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। অন্য পাঁচজন হলেন বিরামপুরের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মচারী মিজানুর রহমান, বাইশধারের রামচন্দ্র তালুকদার লেবু, কামারগাতির ইসলাম উদ্দিন, সিদ্দিকুর রহমান ও বিরামপুরের শান্তু মিয়া। পরে তাঁদের লক্ষ্মীগঞ্জ খেয়াঘাটে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় হানাদাররা রামচন্দ্র তালুকদারের নাম-পরিচয় জেনে গুলিতে বুক ঝাঁজরা করে লাশ সাইডুলি নদীতে ফেলে দেয়। আর ব্যাংকার মিজানুর রহমানকে ছেড়ে দেয়।

পাকিস্তানি সেনারা বদিউজ্জামানের সঙ্গে থাকা হাত গ্রেনেডটি তাঁর গলায় ঝুলিয়ে সারা শহর ঘোরায়। এরপর মোক্তারপাড়া পুরোনো ফৌজদারি ভবনের সামনে উলঙ্গ করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, জ্বলন্ত সিগারেট শরীরে চেপে ধরে নির্যাতন করতে থাকে। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলার শর্তে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখালে শত্রুদের মুখে ঘৃণার থুতু নিক্ষেপ করে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন ‘জয় বাংলা’। ১৫ নভেম্বর ভোররাতে মোক্তারপাড়া সেতুতে নিয়ে বদিউজ্জামানসহ চারজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘাতকের দল বদিউজ্জামানের মৃতদেহ একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। নদীর স্রোতে তিন দিন লাশটি ভাসিয়ে নিয়ে গেলে স্বজনেরা দেওপুর এলাকা থেকে উদ্ধার করে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন।

বদিউজ্জামানের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট নরেন্দ্রনগর গ্রামে। বাবা মাহমুদ ইসহাক ছিলেন কৃষক। মা মোক্তাবেন্নেছা গৃহিণী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তিনি নেত্রকোনা দত্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। অবিবাহিত বদিউজ্জামান বিএ পাস করার পরপরই খালিয়াজুরি উপজেলার সাতগাঁও এম বি পি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

বদিউজ্জামান হত্যা ঘটনায় তাঁর ভাতিজা মো. আলী রেজা বাদী হয়ে ২০১০ সালের ১২ আগস্ট নেত্রকোনা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত-১-এ হত্যা মামলা করেন। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বদিউজ্জামান হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। এতে আসামি ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। অন্যদের মধ্যে চারজন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করেছে।

আলী রেজা জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদ বদিউজ্জামানের মা মোক্তাবেন্নেছাকে সমবেদনা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি চিঠি পাঠান। এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে তাঁদের পরিবারের জন্য মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা পাঠানো হয়। মোক্তারপাড়ায় যেখানে বদিউজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে ‘স্মৃতি-৭১’ নামে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নেত্রকোনা-কেন্দুয়া সড়কের মনাং এলাকায় শহীদ বদিউজ্জামানের প্রকৃতিসংবলিত একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে।

গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা।