বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘাতক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এই দেশের কিছু রাজাকার চিকিৎসক বজলুল হককে বলেছিল তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে। কুখ্যাত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল তাঁকে। ঘৃণাভরে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরিণতি মারাত্মক হবে তিনি জানতেন। হলোও তাই। ঘাতকের দল তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দিল। তাতেও বজলুল হককে আদর্শচ্যুত করতে না পেরে বাড়ির আঙিনাতেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

শহীদ চিকিৎসক বজলুল হকের জন্ম ১৯১৪ সালের ১৫ জুলাই চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার অনুপনগর গ্রামে। বাবা হাজের আলী মুন্সী, মা জেবুন্নেছা। তাঁরা ছিলেন সাত ভাইবোন। বজলুল হকের ছয় ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। স্ত্রী উম্মে কুলসুম মুক্তিযুদ্ধের আগেই মারা গেছেন।

চিকিৎসা পেশার বাইরেও কর্মময় এক বর্ণাঢ্য জীবন ছিল বজলুল হকের। সাহিত্য প্রকাশের বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ, আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ এবং রাজীব আহমেদ সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: চুয়াডাঙ্গা জেলা, অনুপম প্রকাশনীর সুকুমার বিশ্বাস সম্পাদিত একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর—এসব বইতে শহীদ বজলুল হকের জীবনের নানা দিক এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সহযোগিতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেখান থেকে এবং এলাকায় কথাবার্তা বলে তাঁর এই সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

বজলুল হক কলকাতা থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ১৯৩৬ সালে এলএমএফ ডিগ্রি নেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি সরকারি চাকরি শুরু করেছিলেন। পরে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নিজ এলাকাতেই স্বাধীনভাবে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন। সমাজ ও রাজনীতিসচেতন উদার মনের এই মানুষ ধর্মপ্রাণ ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ নন। শিল্প–সাহিত্য বিশেষ করে কবিতার অনুরাগী ছিলেন। মহান ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৫৮ সালে তিনি কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। আলমডাঙ্গা বালিকা বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ভূমিকা রেখেছেন আলমডাঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও।

বজলুল হক নিজ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রাণভয়ে পলায়নপর মানুষদের জন্য খুলেছিলেন লঙ্গরখানা। পাশাপাশি চলছিল যুদ্ধে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও ওষুধপথ্য দেওয়ার কাজ। এসব কারণে রাজাকাররা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। তাদের পরামর্শে বজলুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান পদ গ্রহণের প্রস্তাবও দেওয়া হয়। দৃঢ়চেতা বজলুল হক সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আগের মতোই মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও চিকিৎসার কাজ করে যাচ্ছিলেন। ১০ অক্টোবর ঘাতকের দল তাঁর বাড়িতে আগুন দিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। তাঁর ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। তবু্ নিজ আদর্শে অটল ছিলেন তিনি। মাসখানেক পরে ১২ নভেম্বর আবার ঘাতকের দল বজলুল হকের বাড়িতে হামলা করে। তাঁকে ঘর থেকে বের করে তারা বাড়ির উঠানে এনে গুলি করে হত্যা করে।

শহীদ বজলুল হকের নাম উৎকীর্ণ রয়েছে ঢাকায় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের শহীদ চিকিৎসকদের নামের তালিকায়। আলমডাঙ্গা উপজেলা কমপ্লেক্সের শহীদ কবরস্থানের স্মৃতিফলকেও তাঁর নাম রয়েছে।

গ্রন্থনা: আশীষ–উর–রহমান, ঢাকা