বিজ্ঞাপন
default-image

হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙালিদের গণহত্যা শুরুর দিন থেকেই কার্যত গৃহবন্দী ছিলেন চিকিৎসক লে. কর্নেল নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। পাঁচ দিন পর ৩০ মার্চ তাঁকে বাসা তুলে নিয়ে গিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়।

শহীদ লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর একাত্তরে ছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসে। এর আগের বছর তাঁকে চট্টগ্রামের বিশেষ সামরিক আদালতের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ সময় তিনি অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। পাকিস্তানের পতাকায় আগুন দেওয়ার অভিযোগে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা (চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) এম এ হান্নান ও শ্রী অমূল্য সেনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে তাঁদের অব্যাহতির ব্যবস্থা করেন (অমূল্য সেন ১৯৭২ সালের এপ্রিলে দৈনিক বাংলায় একটি লেখায় এ ঘটনা উল্লেখ করেন)।

শহীদ জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৩১ সালের ১৩ মে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার নারায়ণপুরে। বাবা আবদুল কাদের পেশায় চিকিৎসক। মা জাহানারা বেগম গৃহিণী। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার বড়। ১৯৪৪ সালে পাংশা জর্জ পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রথম শ্রেণিতে মাধ্যমিক ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরের বছর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। ভাষা আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

এমবিবিএস পাস করে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগ দেন। তাঁর স্ত্রী জেবুননেছা জাহাঙ্গীর, তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে চিকিৎসক মারগুব আরেফ জাহাঙ্গীর ঢাকায় ইউনিসেফের একটি প্রকল্পে কর্মরত। বাবার স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তাঁর বাবা সেনা ক্লাবে গিয়ে অস্বাভাবিক পরিবেশ আঁচ করতে পারেন। ২৬ মার্চ তাঁকে হেডকোয়ার্টারে ডেকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও কর্নেল ওসমানী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরদিন তাঁর ইউনিটের সব অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

কর্নেল জাহাঙ্গীর ইউনিটের সদস্যদের ডেকে কিছু অস্ত্র জমা দিয়ে বাকিগুলো লুকিয়ে ফেলতে বলেন। তিনি বলেন, ‘মৃত্যু যদি অনিবার্য হয়, তবে তোমরা তোমাদের হাতের শেষ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে মৃত্যুবরণ করবে। কিন্তু আত্মসমর্পণ করে নিজেকে ও দেশকে কলঙ্কিত করবে না।’

মারগুব আরেফ বলেন, ‘৩০ মার্চ সকাল পৌনে সাতটায় দুই পাকিস্তানি সিপাই বাবাকে নিতে আসে। বাবা আমাদের আদর করেন। আম্মার কাছে তাঁর ০.৩২ রিভলবারটি তুলে দেন। শান্ত গলায় বলেন, “ভয় পেয়ো না। প্রয়োজন হলে অস্ত্রটির সদ্ব্যবহার করো।” সকাল নয়টায় ফোন করে আম্মাকে বলেন, “কর্নেল ইয়াকুব মালিকের (পাকিস্তানি) সঙ্গে কনফারেন্সে যাচ্ছি।” এটাই ছিল বাবার শেষ কথা। তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়। ১৯৭২ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসের গণকবর থেকে তাঁর দেহাবশেষ উদ্ধার হয়। কুমিল্লা সেনানিবাসে ও রাজবাড়ীতে একটি করে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর স্মরণে। এ ছাড়া ঢাকা সিএমএইচে একটি ওয়ার্ডের নামকরণ করা হয়েছে।


গ্রন্থনা: এজাজ আহম্মেদ, রাজবাড়ী