বিজ্ঞাপন
default-image

ধীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ছিলেন নেত্রকোনার খ্যাতিমান আইনজীবী। আইন পেশার পাশাপাশি লেখালেখিসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজ ও স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তিনি। একাত্তরের ২৭ মে পাকিস্তানপন্থী চিহ্নিত কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা অস্ত্রের মুখে তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তুলে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। হানাদার সেনারা ক্যাম্পে নিয়ে টানা তিন মাস দুর্বিষহ নির্যাতন চালিয়ে ১ সেপ্টেম্বর তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। লাশটি ভাসিয়ে দেয় মগড়া নদীতে। স্বজনেরা তাঁর লাশের সন্ধান পাননি।

শহীদ ধীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদারের জন্ম ১৯০৫ সালে নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা গ্রামে। তাঁর বাবা কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদার ছিলেন জোতদার, মা সরলা বালা মজুমদার গৃহিণী। তাঁরা তিন ভাই ও এক বোন। কেউ বেঁচে নেই। ধীরেন্দ্র মজুমদার ১৯২৪ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা থেকে মোক্তারি সনদ নিয়ে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তাঁর স্ত্রীর নাম মুকুল রানী মজুমদার। তাঁদের একমাত্র ছেলে সুব্রত মজুমদার ২০১৯ সালে মারা যান। বড় মেয়ে শীলা রায় মজুমদার সুনামগঞ্জে এবং ছোট মেয়ে ইলা মজুমদার কলকাতায় বসবাস করছেন।

একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি হানাদাররা গণহত্যা শুরু করলে ধীরেন্দ্র মজুমদার তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। বাড়িতে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। নেত্রকোনা শহরের চিহ্নিত কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা ও রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সদস্যরা বিষয়টি জেনে যায়। স্থানীয় চৌকিদারকে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী ওই নেতারা ২৭ মে আইনজীবী ধীরেন্দ্র মজুমদারকে আটক করে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেয়। হানাদাররা তাঁকে মোক্তারপাড়া ক্যাম্পে আটকে রেখে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায়। ২৪ আগস্ট তাঁর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ১ সেপ্টেম্বর রাতে মোক্তারপাড়া সেতুসংলগ্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেয় মগড়ার স্রোতে।

নেত্রকোনার বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১১ নম্বর সেক্টরের মুজিব বাহিনীর উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক হায়দার জাহান চৌধুরী জানান, প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার অধিকারী এই মানুষটিকে চিহ্নিত কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা ও রাজাকার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেয়। পরে তাঁকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

ধীরেন্দ্র মজুমদারকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল, সেই মোক্তারপাড়া সেতুসংলগ্ন বধ্যভূমিতে শিল্পী বিপুল শাহের নেতৃত্বে ‘স্মৃতি ৭১’ নামের একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ গোলাম এরশাদুর রহমানের মুক্তিসংগ্রামে নেত্রকোনা ইতিহাসবিদ আলী আহাম্মদ খান আইয়োবের নেত্রকোনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সঞ্জয় সরকারের নেত্রকোনার লোক-লোকান্তর এবং নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন থেকে প্রকাশিত নেত্রকোনার সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস গ্রন্থে ধীরেন্দ্র মজুমদারের কথা উল্লেখ রয়েছে।

ধীরেন্দ্র চন্দ্রের মেয়ে শীলা রায় মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মায়ের কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। তবে তাঁর বাবার নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীর সরকারি তালিকায় ওঠেনি। পরিবারের পক্ষ থেকে এ জন্য আবেদন করা হয়েছিল।

গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা