একাত্তরের ২১ মে সকাল। কক্সবাজার শহরের লালদিঘির পাড়ে নিজ বাড়ি ‘আনন্দ ভবন’ থেকে আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আইনজীবী জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরী। হঠাৎ একদল রাজাকার বাড়ি ঘেরাও করে অস্ত্রের মুখে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় সমুদ্রসৈকতের পাশে বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের একটি টিনশেড কক্ষে। সেখানে ছয় দিন আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা প্রশিক্ষণের তথ্য জানার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলতে রাজি হননি তিনি।
২৭ মে ভোরে পাঁচজন পাকিস্তানি হানাদার সেনা জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরীকে টিনশেড কক্ষ থেকে বের করে হাঁটা পথ ধরে ডাকঘরের পাশ দিয়ে সমুদ্রসৈকতে (বর্তমান ডায়াবেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট) নিয়ে যায়। সেখানে বালিতে আগে থেকেই একটি বড় গর্ত করে রাখা ছিল। তার পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে জ্ঞানেন্দ্রলালের লাশ সেই গর্তে বালুচাপা দেয় ঘাতক সেনারা। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সৈকত ডাকঘরের তৎকালীন পোস্টমাস্টার। সেদিন ভোরে তিনি ফজরের নামাজ শেষে ডাকঘরের ছাদে পায়চারি করছিলেন। সেখান থেকে তিনি পুরো ঘটনা দেখতে পান। স্থানীয় আইনজীবীদের তিনি এ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন। পরে তিনিও শহীদ হন।
সেদিনের হত্যাকাণ্ড তুলে ধরে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শহীদ জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরী ব্যক্তিগত জীবনে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তবে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থক ও উদার মনের মানুষ। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আইনজীবী স্মারকগ্রন্থে শহীদ জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরীর জীবনী রয়েছে।
জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরীর জন্ম ১৯১৩ সালে। বাবা মণিন্দ্রলাল চৌধুরী ছিলেন কক্সবাজার মহকুমা আদালতের মোক্তার। মা লাবণ্যপ্রভা চৌধুরী। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে কক্সবাজার শহরে পুরোনো তিনটি পাকা বাড়ির একটি ছিল তাঁদের ‘আনন্দ ভবন’। জ্ঞানেন্দ্রলাল ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক পেয়ে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে মুনসেফ পদের জন্য পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েও তিনি চাকরিতে যোগ না দিয়ে আইন পেশায় যুক্ত হন। বিয়ে করেন কবি নবীন চন্দ্র সেনের নাতনি ইরাবতী সেনকে। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও সাত মেয়ে রেখে যান।
একমাত্র সন্তান পীযূষ কান্তি চৌধুরীও আইনজীবী। তিনি এখন কক্সবাজারেই অবসর জীবন যাপন করছেন। বাবার স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বাড়ি থেকে বাবাকে তুলে নেওয়ার পর বিদ্যুৎ বিভাগের একটি টিনশেড কক্ষে টানা ছয় দিন আটকে রাখা হয়েছিল। ২৭ মে সকালে বাবাকে হত্যা করা হয়।’
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলো বিজ্ঞাপন ছাপলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরীর ছবি ও তথ্য পাঠান। সম্পর্কে তিনি জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরীর ভাগনে। রানা দাশগুপ্ত জানান, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন জ্ঞানেন্দ্রলাল। আনন্দ ভবনে তিনি একাই ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা এই ভবনে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালান। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সদস্য চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নিলে জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরী তাঁদের সার্বিক সহযোগিতায় করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়া ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন।
গ্রন্থনা: আব্দুল কুদ্দুস, কক্সবাজার