বিজ্ঞাপন
default-image

বিকেল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। বাড়ির উঠানে পানি জমেছে। ঘর থেকে সদর দরজা পর্যন্ত একটি একটি করে ইট বিছানো। রাত তখন নয়টা। মেহেরপুরের সাহারবাটি গ্রামে উজির আলী মালিথ্যা রাতের খাবার খেয়ে জানালায় পাশে বসে ছিলেন। এমন সময় সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। প্রচণ্ড ধাক্কার একপর্যায়ে দরজাটি খুলে যায়। উর্দি পরা একদল সেনা দ্রুত বাড়িটি ঘিরে ফেলে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন উজির আলী। বর্বর সেনারা স্ত্রী ও গৃহকর্মীর সামনে তাঁকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটাতে থাকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। বর্বরের দল টেনেহিঁচড়ে তাঁকে বাইরে এনে চোখ বেঁধে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায় ভাটপাড়া ক্যাম্পে।

সেদিন ছিল একাত্তরের ১৫ আগস্ট। গভীর রাতে উজির আলী, তাঁর বন্ধু এমলাক হোসেনসহ ছয়জন বুদ্ধিজীবীকে ক্যাম্পে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। লাশ ভাসিয়ে দেয় পাশের কাজলা নদীর স্রোতে। তাঁদের আর সন্ধান পায়নি পরিবার। শহীদ উজির আলী মালিথ্যার পুরো পরিবারই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত।

একাত্তরের ২৬ মার্চে উজির আলীর বড় ছেলে আক্কাস আলীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সাহারবাটি ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদ। মেজ ছেলে আকরাম আলী যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বেতাই ক্যাম্পে চলে যান। উজির আলীও নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছিলেন। আত্মীয়স্বজন তাঁকে দেশত্যাগের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু দেশ ছাড়তে রাজি হননি তিনি।

প্রথম আলোতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আবদুল্লাহ-আল-আমিন শহীদ উজির আলী মালিথ্যার ছবি ও তাঁর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা পাঠান। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়।

‍উজির আলীর জন্ম ১৯১৫ সালে নদীয়া জেলার করিমপুরে। বাবা দিরাজতুল্লাহ ছিলেন সচ্ছল কৃষক, মা সাবেরা বেগম গৃহিণী। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তাঁরা মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। উজির আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় এ এলাকায় অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাহারবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভাটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় অন্যতম।

সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও উজির আলী ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। প্রতিরোধযুদ্ধের সূচনালগ্নে তাঁর বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন বৈঠকের কেন্দ্র। সাহিত্যিক রফিকুর রশীদের লেখা আগামী প্রকাশনীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা গ্রন্থে উজির আলী মালিথ্যাকে ‘মুক্তমনা ও সংস্কৃতিপ্রাণ’ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার দেওয়া ও অস্ত্রপাতি রাখার ব্যবস্থা করতেন। এলাকার যুবক-তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর এবং মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আবদুল্লাহ আল আমিনের ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকের বাংলাদেশ গ্রন্থে উজির আলীকে সমাজসেবী, বিদ্যোৎসাহী, সংস্কৃতিসেবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

উজির আলীসহ শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। উজির আলীর নাতি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক খালেদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দাদা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।’

গ্রন্থনা: আবু সাঈদ, মেহেরপুর