বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর পৈশাচিক তাণ্ডবে একাত্তরে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার বামুন্দী এলাকার গ্রামগুলো ছিল বিপর্যস্ত। বহু মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের নদীয়ার করিমপুর ও শিকারপুরে আশ্রয় নেয়। তবে বেশ কিছু সাহসী মানুষ এলাকায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছিলেন। সংগীতশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবুল কাশেম তাঁদের একজন। তিনি গোপনে স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন। স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা তাঁকে পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করতে চাপ দিতে থাকে। বিপদ আঁচ করতে পেরে সেদিন তিনি তাঁর আত্মীয় হারিস উদ্দীনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।

সেদিন ছিল ১৫ আগস্ট। গভীর রাতে গাংনী শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বামুন্দী গ্রামের হারিস উদ্দীনের বাড়ির সামনে এসে থামে হানাদার সেনাদের ট্রাক। এই বাড়িতেই আত্মগোপন করেছিলেন আবুল কাশেম। রাজাকাররা হানাদার সেনাদের এই খবর জানিয়ে বাড়িটি চিনিয়ে দেয়। হারিস উদ্দীনের লাইসেন্স করা বন্দুক ছিল। তিনি ও আবুল কাশেম ঘাতক সেনাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের ভারী অস্ত্রের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুক কোনো কাজে আসেনি। তাঁদের দুজনকে হানাদার সেনারা চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় ভাটপাড়া ক্যাম্পে। সেখানে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আবদুল্লাহ আল-আমিন শহীদ আবুল কাশেমের ছবি ও তাঁর কর্মজীবন নিয়ে বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ লেখা পাঠান। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয় (প্রসঙ্গত, ৮ নভেম্বর এই কলামে প্রকাশিত কুষ্টিয়ার শহীদ বুদ্ধিজীবী খালেদ সাইফুদ্দীন আহমেদের তথ্য ও ছবিও তিনি পাঠিয়েছিলেন, তবে প্রতিবেদনে তা ভুলবশত উল্লেখ করা হয়নি)।

আবুল কাশেমের জন্ম ১৯১৬ সালে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামুন্দী গ্রামে। পিতা করিম বকসো বিশ্বাস ছিলেন মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির গোমস্তা ও জোতদার। মা অলিমুন্নেছা বেগম গৃহিণী। বামুন্দী বাজারে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হন। তবে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাংস্কৃতিক চর্চা ও খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। বামুন্দী-নিশিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বামুন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।

শহীদ আবুল কাশেম ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক। গ্রামের তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে কাজ করতেন। কুষ্টিয়ার দিক থেকে মেহেরপুর জেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্ভাব্য আগমন ও আক্রমণ প্রতিরোধে খলিশাকুন্ডি সেতু পাহারায় নিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ তদারকি করেছেন। গাংনী থানায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশের আগপর্যন্ত তৎকালীন বেসামরিক প্রশাসনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এলাকার তরুণ-যুবক ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর এবং মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আবদুল্লাহ আল আমিনের ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকের বাংলাদেশ গ্রন্থে শিক্ষক আবুল কাশেমকে শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রফিকুর রশীদের লেখা আগামী প্রকাশনীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা গ্রন্থে আবুল কাশেমকে ‘গাংনী থানার স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শহীদ আবুল কাশেম এবং একাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ চলছে।

আবুল কাশেমের স্ত্রী ও তাঁদের ৯ ছেলেমেয়ের মধ্যে এক মেয়ে মারা গেছেন। ছোট ছেলে ব্যবসায়ী রেজা পারভেজ বলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে এলাকায় নেতৃত্বদানের জন্য আমার বাবা ও ফুফা শহীদ হয়েছেন। আমাদের বাড়িঘরে লুটপাট চালানো হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের পরিবার অনেক দুর্ভোগ সয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বাবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।’

গ্রন্থনা: আবু সাঈদ, মেহেরপুর