বিজ্ঞাপন
default-image

আবদুল মালেক আকন্দ ছিলেন সম্ভাবনাময় কবি ও অভিনেতা। এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যমী আয়োজক। যাত্রাপালায় অভিনয় করে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ভালো আবৃত্তি করতেন। তবে তাঁর প্রতিভার বিকাশ হয়নি। পাকিস্তানি হানাদার সেনারা প্রচণ্ড নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে।

শহীদ আবদুল মালেক আকন্দের জন্ম ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা সদর উপজেলার বিরামপুর গ্রামে। বাবা ফয়েজ উদ্দিন আকন্দ ছিলেন কৃষক, মা আনোয়ারা খাতুন গৃহিণী। তাঁরা দুজনই মারা গেছেন। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। অন্য তিন ভাইয়ের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক আকন্দ আইনজীবী, আবদুল খালেক আকন্দ লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আবদুল আওয়াল আকন্দ ব্যবসায়ী। সবার বড় বোন মমতাজ আক্তার মারা গেছেন, অন্যরা গৃহিণী। আবদুল মালেক নেত্রকোনা দত্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে এসএসসি এবং নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একই কলেজের স্নাতক পরীক্ষার্থী ছিলেন।

শহীদ আবদুল মালেক আকন্দের সহপাঠী ও মুক্তিযোদ্ধা ১১ নম্বর সেক্টরের মুজিব বাহিনীর উপ–আঞ্চলিক অধিনায়ক প্রাবন্ধিক হায়দার জাহান চৌধুরী জানান, আবদুল মালেক এলাকার বিভিন্ন সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কবিতা লিখতেন ও আবৃত্তি করতেন। চমৎকার অভিনয়, বিনয়ী ও শান্ত স্বভাবের কারণে সবার কাছেই তিনি প্রিয়পাত্র ছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আবদুল মালেক উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানের সময় থেকেই স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করছিলেন। একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি হানাদারেরা গণহত্যা শুরু করলে তিনি এলাকার তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সংগঠিত করতে থাকেন। তথ্য আদান–প্রদানসহ নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছিলেন।

একাত্তরের ১৪ নভেম্বর দুপুরে বদিরুজ্জামান মুক্তাসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এলাকার অবস্থা রেকি করতে বিরামপুর বাজারে অবস্থান করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন মালেক আকন্দ। বিষয়টি স্থানীয় রাজাকাররা জেনে যায়। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজাকার–আলবদরের দল তাঁদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মালেক আকন্দসহ ছয়জনকে আটক করে হাত–পা বেঁধে ফেলে। হানাদার সেনারা তাঁদের নির্যাতন করে নেত্রকোনা শহরে ঘোরায়। এরপর মোক্তারপাড়া পুরোনো ফৌজদারি ভবনের সামনে উলঙ্গ করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, জ্বলন্ত সিগারেট শরীরে চেপে ধরে নির্যাতন করতে থাকে। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলার শর্তে তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখালে শত্রুদের মুখে ঘৃণার থুতু নিক্ষেপ করে দৃঢ় কণ্ঠে সবাই বলে ওঠেন, ‘জয় বাংলা’। একাত্তরের ১৫ নভেম্বর ভোররাতে মোক্তারপাড়া সেতুতে নিয়ে আবদুল মালেক আকন্দসহ চারজনকে গুলি করে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেয় মগড়া নদীতে। স্বজনেরা আর লাশের সন্ধান পাননি।

শহীদ আবদুল মালেক আকন্দের ছোট ভাই আবদুল আওয়াল আকন্দ জানান, দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাবা ফয়েজ উদ্দিন আকন্দকে সমবেদনা জানিয়ে একটি চিঠি ও দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। মোক্তারপাড়া সেতুর বধ্যভূমি, যেখানে আবদুল মালেককে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে শিল্পী বিপুল শাহের নেতৃত্বে ‘স্মৃতি-৭১’ নামে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন থেকে প্রকাশিত নেত্রকোনার সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস গ্রন্থে সাবেক জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম ‘মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনায় গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী নিধন’ প্রবন্ধে আবদুল মালেকের কথা উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসবিদ আলী আহাম্মদ খান আইয়োবের নেত্রকোনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থেও শহীদ আবদুল মালেকের কথা রয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত নেত্রকোনা কলেজ বার্ষিকী উত্তরকণ্ঠ–এ তাঁর জীবনী রয়েছে।

গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা