দেশের জন্য মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান রেখে নিজের জীবন তুচ্ছ করে রণাঙ্গনে ছুটে গিয়েছিলেন বাংলার বীর সন্তানেরা। তেমনই একজন ছিলেন প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকায় ওয়াপদার উপপরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন।
নজরুল ইসলাম রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড করে এনে যুবকদের অনুপ্রাণিত করতে শান্তিনগর এলাকায় মাইকে প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে অংশ নেন। পরিবারকে গ্রামে রেখে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সহায়তার কাজ করতে থাকেন। বিদ্যুৎ প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকায় বিদ্যুৎ বিভাগের সাবস্টেশনগুলোর কোথায় বোমা বসালে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ সফল করতে পারবেন, তার বিশদ নকশা মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছিলেন তিনি। অংশ নিয়েছিলেন এসব আক্রমণেও।
এ ছাড়া ভূমি জরিপ অফিস থেকে সারা দেশের নকশা তুলে পাঠিয়েছিলেন আগরতলায় ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে, যেন তাঁরা আক্রমণের জন্য সঠিক মানচিত্র তৈরি করতে পারেন। এরপর রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে স্ত্রী-পরিবার ফেলে ছুটে গেলেন আগরতলায়। পরিবারের কাছ থেকে সেই ছিল তাঁর অন্তিম বিদায়।
প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, যুদ্ধকালে তাঁর পরিবারের অবস্থা—এসব নিয়ে দীর্ঘ স্মৃতিচারণা করছেন তাঁর স্ত্রী হাজেরা নজরুল। বাংলা একডেমি থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি: ১৯৭১ বইয়ের পুনর্বিন্যাসকৃত প্রথম সংস্করণে এই লেখা রয়েছে। তিনি বর্ণনা করেছেন, একাত্তরের ২০ জুলাই রাতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের সহায়তায় ঢাকার পাওয়ার স্টেশনে কয়েকটি সফল আক্রমণ চালান।
হাজেরা নজরুল লিখেছেন, ‘রাত গভীর হচ্ছে। ছাদের ওপরে আমরা দুজন। কেঁদে বললাম, না গো, তুমি আমাকে একা ফেলে যেয়ো না।...ও মাথায় হাত রেখে বলল, “উপরে আল্লাহ আছেন। তিনি মেহেরবান। একটা ব্যবস্থা করবেনই। এমন দেশে বন্দি হয়ে বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়া ভালো। আজ তোমাকে যা বললাম, এ অপারেশনের কথা কাউকে বোলো না।”...২২ জুলাই। একটা ফোন এল। টিকাটুলি থেকে। ও এসে বলল, “আগরতলা হতে খবর এসেছে। হায়দার সাহেব লোক পাঠিয়েছেন। আমি যাচ্ছি।”...জিপ চালিয়ে চলে গেল নজরুল। আমি হাত নেড়ে বিদায় দিলাম। এই ছিল শেষ বিদায়।’
হাজেরা নজরুল লিখেছেন, আগস্ট মাসে তিনি নজরুল ইসলামের একটি চিঠি পেয়েছিলেন। লোক মারফত পাঠানো সেই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও। এ ছাড়া উপায় ছিল না। দাদার কাছে সব টাকা গচ্ছিত রেখে এসেছি, মাঝে মাঝে নিয়ে খরচ করো। যদি আর দেখা না হয়, ক্ষমা করো।’
প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯৩২ সালের ৩ আগস্ট শরীয়তপুরের নড়িয়ায়। যন্ত্রপ্রকৌশলে স্নাতক এবং লন্ডন থেকে ডিপ্লোমা করেছিলেন তিনি। সালদা নদীর তীরে একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সৈনিকেরা তাঁকে হত্যা করে। সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।
স্বামীর শোকে বিমূঢ় হাজেরা নজরুল স্মৃতিচারণে গভীর আক্ষেপ নিয়ে লিখেছেন, ‘নজরুলের সঙ্গে ছিল এমন কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়েছেন। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করে, নজরুলের কি কোনো খেতাব প্রাপ্য ছিল না?’
গ্রন্থনা: আশীষ-উর-রহমান।