বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি ট্রাক মৃত্যুদূতের মতো এসে দাঁড়াল মেহেরপুরের গাংনী শহরের সাহারবাটি চারচারা মোড়ে। তখন রাত প্রায় আটটা। স্থানীয় রাজাকাররা এগিয়ে আসে ট্রাকের দিকে। সেনাদের তারা চিনিয়ে দেয় শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এমলাক হোসেনের বাড়ি।

ঘাতক সেনারা দোতলা বাড়িটি ঘিরে ফেলে। সদর দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে ভেতরে। এমলাক হোসেনকে লাঠিপেটা করতে করতে ট্রাকে তোলে। নিয়ে যায় তাদের ভাটপাড়া ক্যাম্পে। সেখানে এমলাক হোসেন ও মুক্তিযোদ্ধা উজির মালিথ্যাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেয় কাজলা নদীতে। ঘটনাটি একাত্তরের ১৫ আগস্টের। তাঁদের লাশ আর পাওয়া যায়নি।

শহীদ এমলাক হোসেন ছিলেন সাহারবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। প্রথম আলোতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ-আল-আমিন এমলাক হোসেনের ছবি, তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা পাঠান। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয়।

দেশের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার এমলাক হোসেন শিক্ষকতার পাশাপাশি গাংনীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ছিলেন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। নাটকে অভিনয় করতেন। মেতে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-আব্বাসউদ্দীনের গানে। পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসনের মধ্যেও নিজ বাড়ির আঙিনায় ও স্কুলমাঠে উদ্‌যাপন করতেন পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী।

এমলাক হোসেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নাটক, গান ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সরাসরি রাজনৈতিক দলে যুক্ত না হয়েও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। মেহেরপুরে প্রতিরোধযুদ্ধের সূচনালগ্নে গাংনী থানার বন্দুকমালিকদের সহযোগিতায় তাঁর নেতৃত্বে বন্দুক বাহিনী গড়ে ওঠে। এসব কারণে স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের ডেকে এনে তাঁকে ধরিয়ে দেয়।

এমলাক হোসেনের জন্ম ১৯২০ সালে ভারতের নদীয়া জেলার গোয়াস-রহমতপুর গ্রামে। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তাঁর পরিবার মেহেরপুরের গাংনীর সাহারবাটি গ্রামে বসতি স্থাপন করে। কুষ্টিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাথুলি এনএস বিদ্যামন্দির থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত পড়ে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর গ্রন্থে শহীদ এমলাক হোসেনসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সাহিত্যিক রফিকুর রশীদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মেহেরপুর জেলা গ্রন্থে এমলাক হোসেনকে ‘মুক্তমনা ও সংস্কৃতি প্রাণ’ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এমলাক হোসেনসহ অন্য শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ ও তাঁদের আট সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে ইন্তেকাল করেছেন। অপর ছয় ছেলে ও এক মেয়ে বেঁচে আছেন। তাঁরা সবাই শিক্ষিত, শিল্প-সংস্কৃতির অনুরাগী ও সরকারি চাকুরে। মেজ ছেলে মেহেরপুর জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক, মুক্তিযোদ্ধা ও চারুশিল্পী গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্বা আমাদের ভারতের নদীয়াতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে আমরা তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। এমন সময় খবর পাই, হানাদার সেনারা আব্বাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ কাজলা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। আব্বা দেশের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন, এটি আমাদের সবচেয়ে গর্বের বিষয়।’

গ্রন্থনা: আবু সাঈদ, মেহেরপুর।