দিনের বেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ভারত থেকে এসে অবস্থান নিল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। তাদের নেতৃত্বে সৈয়দ সদরুজ্জামান। অদূরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। কিছুক্ষণ পর শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড যুদ্ধ। চলল প্রায় ১০ মিনিট। এ ঘটনা ঘটে উঠানিপাড়ায় ১৯৭১ সালের ৯ আগস্টে।
উঠানিপাড়া জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার উত্তর প্রান্তে ধানুয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত। এই যুদ্ধের ঘটনা শোনা যাক তাঁর বয়ানে। ‘...বিএসএফের ক্যাপ্টেন ন্যাগি আমাকে বলল, কামালপুর ক্যাম্পে পাকিস্তানি কম আছে। আজ সেখানে আক্রমণ করা হবে। আমাকে বলা হলো বকশীগঞ্জের দিকে যেতে। সেদিক হয়ে যেন কোনো পাকিস্তানি না আসতে পারে। আমরা ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা উঠানিপাড়ায় অ্যামবুশ করি।
‘আমাদের বলা হয়েছিল, সন্ধ্যার মধ্যে কামালপুর দখল করে সিগন্যাল দেওয়া হবে। সিগন্যাল পেলে আমরা যেন অবস্থান ছেড়ে চলে আসি। তিনটার দিকে কামালপুর সড়কের দুই পাশে অবস্থান নিলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, আমরা অপেক্ষায় আছি। সন্ধ্যায় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো।
‘রাতে পোস্ট অফিসের কাছে শব্দ শুনে আমার সেন্ট্রি সামছু বলে উঠল, কে যায়? আমার সহ-দলনেতা লতা ওদের হ্যান্ডস আপ করাল। জিজ্ঞাসাবাদ ও ভয় দেখানোর পর জানা গেল, ওরা রাজাকার। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, পাকিস্তানি সেনারা আমাদের দিকে আসছে। সেনা কত জন, তা ওরা বলতে পারল না। আমরা দ্রুত পরিকল্পনা করে পজিশন নিলাম।
‘অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। একসময় মনে হলো দলবেঁধে অনেকে হেঁটে আসছে। ১০০ জনের বেশি হবে। কলাম করে হেঁটে আসছে। এক কোম্পানি হয়তো। পাকিস্তানি সেনারা যেই কাছাকাছি এল, দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমরা অবিরত গুলি করছি। ১০ মিনিটের বেশি সময় সম্মুখযুদ্ধ করে আমরা পিছে ফিরতে শুরু করি। তখন পর্যন্ত সিগন্যাল পাইনি। বুঝতে পারি, কামালপুর আক্রমণ করা সম্ভব হয়নি। কামালপুরে মোট ১৮ বার আক্রমণ করা হয়। আমি ১৪ বার আক্রমণে ছিলাম। সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৭ জন হতাহত হয়। আমাদের পক্ষে কেউ আহত বা শহীদ হননি।’
সৈয়দ সদরুজ্জামান ১৯৭১ সালে কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯। মা-বাবার অনুমতি নিয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে ১১ নম্বর সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জ সাবসেক্টরের একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কামালপুরসহ আরও কয়েক স্থানের যুদ্ধে সাহসের সঙ্গে অংশ নেন। তিনি ও তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান