বিজ্ঞাপন
default-image

কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রাস্তায় গর্ত খোঁড়া শুরু করলেন। শাহজামান মজুমদারসহ বাকিরা থাকলেন সতর্ক প্রহরায়। গর্ত খোঁড়া শেষ করে তাতে অ্যান্টিট্যাংক মাইন বসিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিপুণভাবে মাটি ভরাট করলেন। এরপর মাটি খোঁড়ার চিহ্ন যাতে বোঝা না যায় সে জন্য ভরাট গর্তগুলোর ওপর দিয়ে কয়েকবার গাড়ির চাকা গড়াগড়ি করানো হলো। দেখে মনে হবে গাড়ির চাকার দাগ।

এরপর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে অবস্থান নিলেন বিভিন্ন স্থানে। শাহজামান মজুমদার যেখানে অবস্থান নিয়েছেন, সেখান থেকে রাস্তার অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সময় গড়াতে থাকল। তাঁরা ছাড়া আশপাশে কোথাও জনমানুষের চিহ্ন নেই। গোটা এলাকা সুনসান। মাঝেমধ্যে শুধু পাখির কলকাকলি আর বাতাসে পাতা নড়ার শব্দ।

সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। বিশেষত শাহজামান মজুমদার। এটাই তাঁর প্রথম প্রত্যক্ষ অপারেশন। তাঁর কাছে এসএমজি। উত্তেজনায় তাঁর হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। শরীর ঘামছে। চোখ বড় বড় হচ্ছে। এর মধ্যে কেটে গেছে অনেক সময়।

একসময় শাহজামান মজুমদার রাস্তায় দেখতে পেলেন পাকিস্তানি সেনাদের এক কনভয়। প্রথমে একটি জিপ। দ্বিতীয়টি তিন-টনি বেডফোর্ড লরি। তৃতীয়টি একটি পাঁচ-টনি ট্রাক। এরপর একটি বাস। সেগুলো আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। সামনের জিপ মাইনের ওপর দিয়ে চলে গেল। দ্বিতীয় গাড়িও। মাইন বিস্ফোরিত হলো না।

শাহজামান মজুমদারের হাতের আঙুল অস্ত্রের ট্রিগারে। মাইন বিস্ফোরণ হওয়ামাত্র গুলি করবেন। কিন্তু মাইন বিস্ফোরণ না হওয়ায় বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভাবতে থাকলেন, তবে কি কোনো ভুল হয়ে গেল! ঠিক তখনই পাঁচ-টনি ট্রাকের চাকা মাইনের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে মাইনের বিস্ফোরণ। ট্রাকটি কয়েক ফুট ওপরে উঠে গেল। চারদিক কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন।

শাহজামান মজুমদার ও তাঁর সহযোদ্ধারা একযোগে গুলি শুরু করলেন। একদিকে মাইন বিস্ফোরণ, অন্যদিকে গুলি। হতভম্ব পাকিস্তানি সেনারা। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা গুলি শুরু করল। শাহজামান মজুমদার তাঁর এসএমজির দুই ম্যাগাজিন গুলি শেষ করলেন। এরপর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করলেন নিরাপদ স্থানে। এ ঘটনা ঘটে তেলিয়াপাড়ায় ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি। তেলিয়াপাড়া হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। জেলা সদর থেকে দক্ষিণে।

শাহজামান মজুমদার ১৯৭১ সালে ঢাকায় উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে বাড়িতে সবার অনুমতি নিয়ে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় যান। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। ৩ নম্বর সেক্টরে আখাউড়াসহ আরও কয়েকটি জায়গায় যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান