বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ চলছে। ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই সকালে মোহাম্মদ রবিউল্লাহ তাঁর কোম্পানির অধিনায়কের কাছাকাছিই ছিলেন। হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে অধিনায়ক আহত হন। গুলি লেগে অধিনায়কের হাতে থাকা স্টেনগান ও ওয়্যারলেস ছিটকে পড়ে দূরে। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। রবিউল্লাহর চোখের সামনেই ঘটে ঘটনাটা। অধিনায়ক তাঁকে বললেন, স্টেনগান ও ওয়্যারলেস উদ্ধার করে পেছনে যেতে। যুদ্ধের ময়দানটা দুই পক্ষের লাশে ভরে গেছে। তিনি গুলি-পাল্টা গুলির মধ্যেই অধিনায়কের স্টেনগান, ওয়্যারলেস ও এক শহীদ সহযোদ্ধার লাশ নিয়ে ক্রল করে পেছনে যাচ্ছেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো, আহত অধিনায়ককে বাঁচাতে তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন। গ্রেনেড হাতে নিয়ে তিনি আবার ছুটলেন সেদিকে। এবার দৌড়েই গেলেন। কিন্তু গিয়ে দেখেন, তাঁর অধিনায়ক সেখানে নেই। ঠিক তখনই রবিউল্লাহ নিজেও গুলিবিদ্ধ হলেন। পড়ে গেলেন মুখ থুবড়ে। বুকে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মিনিটও যায়নি, আরেকটি গুলি লাগল তলপেটের নিচে। তিনি যে স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, সে স্থানটা তাঁর সহযোদ্ধাদের রক্তে আগে থেকেই রঞ্জিত ছিল। তাঁর বুক ও তলপেট থেকে রক্ত ঝরছিল। তিনি কোনোরকমে উঠে গুলির মধ্যেই পেছনে যেতে থাকলেন। বৃষ্টির মতো গুলি পড়ছে। কিন্তু আর কোনো গুলি লাগল না তাঁর গায়ে। অন্যের সাহায্য ছাড়াই দূরে একটি খেতে পৌঁছালেন তিনি। বুঝতে পারলেন, বেঁচে যাবেন। কিন্তু তাঁর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে।

খেতের পানিতে শুয়ে আছেন তিনি। তিন পাকিস্তানি সেনাকে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। তিনি গ্রেনেড হাতে লড়াই করে মরার সংকল্প নিলেন। পাকিস্তানি সেনারা অবশ্য তাঁর কাছে আসেনি। তাঁকে মৃত ভেবে দূর থেকেই চলে যায়। এরপর তিনি উঠে দৌড় দেন। সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করে গুয়াহাটি হাসপাতালে পাঠান। সেখানে তাঁর চিকিত্সা হয়।

এই যুদ্ধ হয় জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুর বিওপিতে। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত একটি ঘাঁটি ছিল। জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের (তিনি কিছুদিনের জন্য ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন) নির্দেশে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেখানে আক্রমণ করে। তাদের সঙ্গে ছিল গণবাহিনীর একদল স্বল্প প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। রবিউল্লাহ ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ব্রাভো কোম্পানিতে। তাঁর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন (বীর বিক্রম, পরে মেজর)। ৩০ জুলাই রাতে সেখানে হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাসল্ট ফরমেশন তৈরিতে দেরি হয়। অন্যদিকে, ভারত থেকে ছোড়া কামানের গোলা ভুলক্রমে তাঁদের ওপরই এসে পড়ে। সব মিলিয়ে কিছুটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। তার পরও মনের জোর ও অদম্য সাহসে ভর করে তাঁরা সেদিন কামালপুরে আক্রমণ করেন।

মোহাম্মদ রবিউল্লাহ ১৯৭১ সালে যশোর সেনানিবাসে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চের পর তাঁরা আক্রান্ত হন। তখন তাঁরা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যশোরের চৌগাছায় সমবেত হন। সীমান্ত এলাকায় থাকার সময় এপ্রিলের শেষ দিকে বেনাপোলে যুদ্ধ করেন। এরপর তাঁদের ভারতের তেলঢালায় পাঠানো হয়। তিনি পরে সুস্থ হয়ে সিলেট এলাকায় যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান