মো. আবদুল কুদ্দুসসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা গোপনে এসেছেন বাংলাদেশের ভেতরে। তাঁদের অবস্থান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে। একদিন রাতে তাঁরা গোপন অবস্থান থেকে বেরিয়ে পড়েন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, মো. আবদুল কুদ্দুস তাঁর দল নিয়ে অবস্থান নেন আক্রমণস্থলের অদূরে একটি সেতুর কাছে। তাঁর ওপর দায়িত্ব, তাঁদের মূল আক্রমণকারী দলের নিরাপত্তা দেওয়া এবং আক্রমণ চলাকালে আক্রান্ত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য যাতে কোনো সাহায্য (রিইনফোর্সমেন্ট) যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা।
মুক্তিযোদ্ধাদের মূল আক্রমণকারী দল নির্ধারিত সময়েই আক্রমণ চালায়। তাদের প্রথম রকেটের নির্ভুল আঘাতেই সেখানকার জেনারেটর অকেজো এবং সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা অন্ধকারে ছেয়ে যায়। আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত।
তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদের সামলে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু তাদের শেষরক্ষা হয়নি। প্রচণ্ড আক্রমণে ছিন্নভিন্ন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা বাঁচার জন্য সেতু এলাকা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন মো. আবদুল কুদ্দুসের দলের আক্রমণে তারা বেশির ভাগ নিহত হয়। এ ঘটনা ঘটে ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই বাহাদুরাবাদ ঘাটে। ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি।
ঘাটে তখন পাঁচটি জেটি ছিল। এর মধ্যে দুটি যাত্রীবাহী স্টিমার, দুটি সামরিক যানবাহন, রেল ওয়াগন, তেলের ট্যাংকার, একটি সি-ট্রাক ও লঞ্চ সামরিক (আর্টিলারিসহ) মালামাল পারাপারের কাজে ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়া সেখানে ছিল রেলওয়ের ওয়ার্কশপ, পাওয়ার হাউস ও অন্যান্য স্থাপনা। সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনা ও ইপিসিএএফ নিহত হয়। পুরোপুরি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় জেটি, স্টিমার, কয়েকটি রেলবগি, ওয়াগন এবং অন্যান্য স্থাপনা।
মো. আবদুল কুদ্দুস চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানিতে। রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মার্চ মাসে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে তাঁদের সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। তিনি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে মোতায়েন ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার।
তাঁদের কোম্পানির অধিনায়ক ছিল অবাঙালি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা সিনিয়র জেসিওর নেতৃত্বে যুদ্ধে যোগ দেন। পার্বতীপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে তাঁরা অ্যামবুুশ করেন। এ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে চলে যান। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। বাহাদুরাবাদ, বৃহত্তর সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, রাধানগর, ছাতকসহ বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধে তিনি সাহস, দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান