বিজ্ঞাপন
default-image

সুরমা নদীর তীরে ছাতক। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০-১১ মাইল দূরে তার অবস্থান। ১৯৭১ সালে ছাতক ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। নিয়োজিত ছিল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ইপিসিএএফ ও স্থানীয় রাজাকার বাহিনী।

১৪ অক্টোবর ভোরে মুক্তিবাহিনীর ব্যাটালিয়ন শক্তির একটি দল সেখানে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন কয়েকটি দলে বিভক্ত। এই আক্রমণে সি দলে ছিলেন মালু মিয়া। এই দলের ওপর কাট অফ পার্টি হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব ছিল, যাতে দোয়ারা বাজার হয়ে ওয়াপদার বাঁধ বা সুরমা নদীপথ ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কোনো রিইনফোর্সমেন্ট না আসতে পারে।

১৩ অক্টোবর রাতে মালু মিয়া ও তাঁর সহযোদ্ধারা ভারতের বাঁশতলা থেকে রওনা হন। তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থান নেওয়ার কথা ছিল ছাতকের কাছে টেংরাটিলায়। খুব ভোরে কয়েকটি নৌকায় সেখানে পৌঁছামাত্র তাঁদের নৌকা লক্ষ্য করে ছুটে আসতে থাকে গুলি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের সব নৌকা লক্ষ্য করে একযোগে আক্রমণ চালায়।

আকস্মিক এই ঘটনার জন্য মালু মিয়া ও তাঁর সহযোদ্ধারা মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। প্রথম ধাক্কাতেই তাঁদের দলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাঁর সহযোদ্ধা অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ বা আহত হন। ব্যাপক গুলির মধ্যে জীবন বাঁচাতে তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা পানিতে ঝাঁপ দেন। নৌকাগুলো পানিতে ডুবে যায়। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কারও কারও অস্ত্র হাত থেকে পানিতে পড়ে হারিয়ে যায়।

জীবন-মৃত্যুর এই চরম সন্ধিক্ষণে মালু মিয়া মনোবল হারাননি। চারদিকে গভীর পানি। আশপাশে ছিল না কোনো শুকনা স্থান বা আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গা। গোলাগুলির মধ্যে সেখানে থাকা মানে নির্ঘাত প্রাণ হারানো। তার পরও সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে তিনি সাঁতাররত অবস্থাতেই তাঁর অস্ত্র থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি শুরু করেন।

তাঁর সাহসিকতা দেখে অন্য যাঁদের অস্ত্র হারিয়ে যায়নি, তাঁদের কেউ কেউ অনুপ্রাণিত হয়ে গুলি করতে শুরু করেন। এতে অস্ত্রহীন মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণে সুবিধা হয়। সেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও অনেকে আহত হন।

মালু মিয়া চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাতে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাঁকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ, দেওয়ানগঞ্জ, সিলেট জেলার ছাতক, সালুটিকর, টেংরাটিলাসহ আরও কয়েকটি জায়গায় তিনি সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান