বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর। মুক্তিবাহিনীর চারটি দল রওনা হলো টেংরাটিলার উদ্দেশে। একটি দলে আছেন মমতাজ উদ্দিন (মমতাজ মিয়া)। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা অবস্থান নিলেন টেংরাটিলার ডান পাশে। তাঁরা মূল আক্রমণকারী দল।

সকাল সাতটায় মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। গোলাগুলি ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।

টেংরাটিলায় পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ছিল যথেষ্ট দৃঢ়। তাদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারেননি। সারা দিন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে চলে। অবশ্য এর মধ্যে কয়েকবার পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা তা ব্যর্থ করে দেন।

এরপর রাতে মমতাজ উদ্দিন দুঃসাহসিক এক কাজ করে বসেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের তিন দিকে ছিল জলাশয়। তিনি কয়েকটি গ্রেনেডসহ একাই বরফশীতল পানিতে নেমে কচুরিপানায় নিজেকে আড়াল করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান ওই প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে। পাকিস্তানি সেনারা বুঝতে পেরে গুলি শুরু করে। এতে তিনি দমে যাননি। সহযোদ্ধাদের পাল্টা গুলিবর্ষণের ছত্রচ্ছায়ায় সাহসের সঙ্গে তিনি এগিয়ে যান। একপর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হন পাকিস্তানি অবস্থানের কাছে।

তারপর সুযোগ বুঝে জলাশয় থেকে ভূমিতে উঠে রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে চলে যান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের একদম কাছে। বারবার অবস্থান পরিবর্তন করে তিনি তাঁর কাছে থাকা সব গ্রেনেড একের পর এক ছুড়ে মারেন। প্রথমটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলে পাকিস্তানি সেনারা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। পরে তাদের গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়।

মমতাজ উদ্দিন বাকি রাত সেখানেই ঘাপটি মেরে থাকেন। খুব ভোরে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানে উঁকি দিয়ে দেখেন, সেখানে কোনো সাড়াশব্দ নেই। তখন তিনি আড়াল থেকে কয়েকটি গুলি ছোড়েন। কিন্তু পাকিস্তানি অবস্থান থেকে পাল্টা গুলি হয়নি। সকালে দেখেন, পুরো ক্যাম্প খালি। কোথাও পাকিস্তানি সেনা নেই। ক্যাম্পে রান্না করা খাবার পড়ে আছে। তারা পালিয়ে গেছে।

মমতাজ উদ্দিন চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে তিনি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাঁকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ, বৃহত্তর সিলেট জেলার ছাতক, সালুটিকরসহ আরও কয়েকটি জায়গায় তিনি সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান