বিজ্ঞাপন
default-image

ভোর চারটার আগেই ভুলু মিয়া তাঁর দল নিয়ে অবস্থান নিলেন বাহাদুরাবাদ রেলঘাটের জংশন পয়েন্টে। তাঁরা কয়েকটি দলে একযোগে আক্রমণ করবেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাহাদুরাবাদ ঘাট অবস্থানে। তাঁদের সবার নেতৃত্বে রয়েছেন লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খান (বীর বিক্রম)। নির্দিষ্ট সময়ে ভুলু মিয়া সহযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ চালালেন পাকিস্তানি সেনাদের আবাসিক কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত যাত্রীবাহী রেলবগিতে। রকেট লঞ্চার দিয়ে গোলাবর্ষণ এবং একযোগে অনেকগুলো হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়লেন। পাঁচটি রেলবগি ধ্বংস হয়ে গেল। বগিতে ঘুমিয়ে থাকা বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হলো। কিছু পাকিস্তানি সেনা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সাঁতার না জানায় তাদের বেশির ভাগই ডুবে মারা গেল।

এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাইয়ের। বাহাদুরাবাদ ঘাট তখন ছিল দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান যোগাযোগমাধ্যম। সেদিন মুক্তিবাহিনীর হঠাত্ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত হয়ে পড়লেও কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।

ভুলু মিয়া সেসব উপেক্ষা করে সহযোদ্ধাদের নিয়ে অপারেশন চালিয়ে যান। একটি শানটিং ইঞ্জিনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন তিনি। সম্মুখযুদ্ধও করতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি স্থাপনা ধ্বংস করে তিনি সামনাসামনি যুদ্ধ করছিলেন। তখনই পাকিস্তানি সেনাদের খুব কাছে থেকে ছোড়া একটি বুলেট তাঁর বুকের বাঁ পাশে লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। পিঠের পেছনে তখন বড় গর্ত। গায়ের গেঞ্জি খুলে দলা করে পিঠের গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করতে লাগলেন। এ সময় তাঁদের অধিনায়ক অপারেশন শেষ করার সিগন্যাল দিলেন। এরপর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে ক্রল করে পেছনে যেতে থাকলেন। তখনো তাঁর সহযোদ্ধারা বুঝতে পারেননি তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত। পেছনে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁরা বুঝতে পারলেন, তাঁদের দলনেতা আহত। সে সময় তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এরপর সহযোদ্ধারা তাঁকে ফিল্ড চিকিত্সাকেন্দ্রে পাঠান। সুস্থ হওয়ার পর তিনি আবার যুদ্ধে যোগ দেন। পরে যুদ্ধ করেন বৃহত্তর সিলেটের গোয়াইনঘাট, ছাতক, রাধানগরসহ কয়েকটি জায়গায়।

ভুলু মিয়া ইপিআরে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। ২৮ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের আক্রমণ করে। দুর্যোগপূর্ণ ওই মুহূর্তে ভুলু মিয়া বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত বাঙালি ইপিআর সেনারা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভারতে যাওয়ার পর তাঁদের নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান