সালুটিকর সিলেট জেলার অন্তর্গত। শহর থেকে সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। নবাটিলার দক্ষিণ দিক ঘেঁষে বিমানঘাঁটি এলাকা। সালুটিকরে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষাব্যূহ। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী সেখানে আক্রমণ করে। কয়েক দিন যুদ্ধ চলে। ১২ ডিসেম্বরের যুদ্ধই ছিল চূড়ান্ত যুদ্ধ। সেদিন সকাল থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে আর্টিলারি আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীও পাল্টা জবাব দেয়। পরে পাকিস্তানি সেনারা মার্চ করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের একদম কাছে চলে এলে কৌশলগত কারণে এস আই এম নূরুন্নবী খান সহযোদ্ধাদের গুলি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে পাশের দাড়িকান্দি দখল করে নদীর তীরবর্তী চৌধুরীকান্দি ও কচুয়ারপাড় এলাকায় আসতে থাকে। কাছেই ছিল ফরেস্ট ডাকবাংলো। সেখানে একদল মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন অধিনায়ক এস আই এম নূরুন্নবী খান। তাঁর সঙ্গে আছেন মিত্রবাহিনীর কর্নেল রাজ সিং। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের অবস্থানের ২০০ গজের মধ্যে আসামাত্র রাজ সিং বারবার নূরুন্নবী খানকে গুলি করার অনুরোধ জানান। দুঃসাহসী নূরুন্নবী খান তা না করে বললেন, শত্রুদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হবে।
পাকিস্তানি সেনারা এক সারিতে এগিয়ে আসতে থাকে। তারা ভেবেছিল, মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে গেছেন। ১০ গজের মধ্যে আসামাত্র নূরুন্নবী খান তাদের লক্ষ্য করে বলেন, হ্যান্ডস আপ। এতে পাকিস্তানি সেনারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। সামনে থাকা কয়েকজন সঙ্গে সঙ্গে আত্মসমর্পণ করে। পেছনে থাকা পাকিস্তানি সেনারা এদিক-সেদিক দৌড়ে পালায়। তারপর শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত হয় বহু পাকিস্তানি সেনা। বন্দী হয় বেশ কয়েকজন। সন্ধ্যার মধ্যেই গোটা সালুটিকর এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
এস আই এম নূরুন্নবী খান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় প্রশিক্ষণরত ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। ২৭ মার্চ সেখান থেকে কৌশলে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সঙ্গে ঢাকায় এসে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভারতে যাওয়ার পর তিনি কিছুদিন মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে বাহাদুরাবাদ, ছাতক, গোয়াইনঘাট, রাধানগর, ছোটখেল ও সালুটিকর যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, প্রথম খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১২
সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান