বিজ্ঞাপন
default-image

কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত। মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। রাতে যুদ্ধবিরতির সময় পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ আধা ঘুমে, কেউ জেগে, এ সময় হঠাত্ তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। নিমেষে শুরু হয়ে যায় প্রচণ্ড যুদ্ধ।

ইবনে ফজল বদিউজ্জামান এতে বিচলিত হননি। সাহসের সঙ্গে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়। মুহুর্মুহু শেল ও রকেট এসে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আহতের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলে।

আক্রমণের প্রচণ্ডতায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন। কেউ কেউ পিছু হটে যান। এই পরিস্থিতিতে অধিনায়কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইবনে ফজল বদিউজ্জামান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেন। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে নিজের জীবন বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে সহযোদ্ধাদের মনে সাহস ফিরিয়ে আনেন।

তাঁর প্রচেষ্টায় সহযোদ্ধারা পুনরায় সংগঠিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে সাহসের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালান। তাঁদের বীরত্বে থেমে যায় বেপরোয়া পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। যুদ্ধ চলতে থাকে। দিনব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্ত হয় আজমপুর রেলস্টেশনসহ বিরাট এক এলাকা। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দিকে।

যুদ্ধের একপর্যায়ে ইবনে ফজল বদিউজ্জামান অগ্রভাগে থেকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। হতোদ্যম পাকিস্তানি সেনারা তখন পিছু হটছে। এ সময় হঠাত্ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া বোমা পড়ে তাঁর পাশে। স্প্লিন্টারের আঘাতে শহীদ হন তিনি।

এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। ঘটে আখাউড়া রেলজংশনের কাছে আজমপুর রেলস্টেশনের অবস্থানে। অদূরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। আখাউড়া-আজমপুর ১৯৭১ সালে সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই এলাকায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নবীন সেনা কর্মকর্তা (লেফটেন্যান্ট) ইবনে ফজল বদিউজ্জামান ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ২৯ ক্যাভেলরি (লঞ্চার) ইউনিটে। এর অবস্থান ছিল রংপুর সেনানিবাসে। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেখানে কর্মরত বাঙালি দুজন সেনা কর্মকর্তা ছাড়া তাঁকেসহ অন্যান্য বাঙালি সেনাকর্মকর্তাকে বন্দী এবং বেশির ভাগকে পরে হত্যা করে। তবে তাঁকে হত্যা করেনি। ২ আগস্ট তিনি সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের অধীন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি ব্রাভো কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। বিভিন্ন স্থানে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান