বিজ্ঞাপন
default-image

আবু তাহের কামালপুরের উত্তরে বর্ডার লাইনে তেঁতুলগাছের কাছে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। সকালের দিকে যুদ্ধের তীব্রতা কিছুটা কমে আসে। যুদ্ধক্ষেত্রের অগ্রভাগ থেকে একজন উপদলনেতা তাঁকে জানান, তাঁরা পাকিস্তানি দুর্গের প্রায় ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। বিজয় প্রায় হাতের মুঠোয় ভেবে এ সময় তাহের দ্রুত সামনে যান।

আনুমানিক সকাল নয়টা। হঠাত্ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি শেল পড়ে আবু তাহেরের ঠিক সামনে। শেলের বড় এক স্প্লিন্টার লাগে তাঁর পায়ে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তিন-চারজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। আশপাশে ছিলেন আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা দ্রুত এসে তাঁকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।

এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বরের। কামালপুর জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত। মুক্তিযোদ্ধারা আবু তাহেরের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মূল প্রতিরক্ষায় ঢুকে পড়েন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা মাইন ও গুলির আঘাতে হতাহত হন। শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে তাঁর একটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু একটু চামড়ার সঙ্গে ঝুলে ছিল। পরে তাঁকে ভারতের গৌহাটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

আবু তাহের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নে (স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ) চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুলাই মাসে আরও কয়েকজনের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি ভারতে যান।

মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর তাহেরের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর একের পর এক আক্রমণ করেন। এতে পাকিস্তানি সেনারা তটস্থ হয়ে পড়ে।

এখন আবু তাহেরের নিজের বয়ানে (১৯৭৩) মুক্তিযুদ্ধকালের কিছু কথা শোনা যাক। ‘মুক্তিবাহিনীর প্রধানের নির্দেশে আগস্টের ১২ তারিখে আমি মেঘালয়ে পৌঁছাই। ওই এলাকার মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডে আগে থেকেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কামালপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের মস্ত ঘাঁটি। সিদ্ধান্ত নিলাম কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণের।

‘১৫ আগস্ট আমি ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সন্ধ্যার দিকে কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করি। আমাদের অস্ত্র বলতে ছিল এলএমজি, রাইফেল এবং কিছু স্টেনগান। আক্রমণ দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। আমাদের আক্রমণে ১৫-১৬ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

‘১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে আমি একটা জিনিস দেখে বারবার অবাক হয়েছি। প্রত্যয় আর দৃঢ়তায় সকালের সূর্যের মতো হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হতে না পেরে অতৃপ্তির ব্যথা নিয়ে ফিরে গেছে। তারপর যুবশিবিরে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেওয়ার ডাক আসে।’

সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩

সম্পাদক: মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান