বিজ্ঞাপন
default-image

দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র ২৭ জুলাই জানায়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের একটি ঘরোয়া বৈঠক ডাকবেন। এ জন্যই তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর অভিমত জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। সূত্রটি জানায়, উ থান্টের প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে ভারতের অবস্থান এবং নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উঠলে ভারতের প্রতিনিধির নীতি কী হবে, তা স্থির করার জন্য দিল্লিতে ভারত সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে।

উ থান্টের প্রস্তাবিত নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনীতিবিষয়ক কমিটিতে আলোচনা হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব প্রস্তাব করেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা চাইলে
বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকা যাবে।

চার মাস ধরে বাংলাদেশে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর সৃষ্টি করা বিভীষিকা নিয়ে উ থান্টের প্রস্তাবে কিছু না থাকায় ভারত সরকার বিস্ময় প্রকাশ করে। রাজনীতিবিষয়ক কমিটি উ থান্টের প্রস্তাব অনুযায়ী শুধু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার বিরোধী। সরকারের এ অভিমত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের জানিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। কারণ, সরকার মনে করে, বাংলাদেশ ও ইসলামাবাদের সামরিক চক্রের বিরোধই আসল বিষয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশি শরণার্থীদের ভারত থেকে দেশে ফিরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না বলে পাকিস্তানের করা অভিযোগকে ভাঁওতা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ভারত সরকার একাধিকবার সুস্পষ্টভাবে বলেছে, শরণার্থীরা শিগগির সম্ভব দেশে ফিরে যাওয়াটাই তাদের কাম্য। দিল্লিতে ২৭ জুলাই কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট ফোরাম আয়োজিত সমাবেশের বক্তৃতায় তিনি এ মন্তব্য করেন। সমাবেশে যোগদানকারীরা এর আগে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভারতবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।

লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সমর্থকদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট আইনবিদ শন ম্যাক্সব্রাইড পাকিস্তানে যাবেন। শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার এবং তাঁর প্রাণদণ্ডের আশঙ্কা রোধ করাই তাঁর পাকিস্তান সফরের উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁকে তাঁর মক্কেল শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয় কি না, সেটি উদ্বেগের সঙ্গে সবাই লক্ষ করছিলেন।

চীনের সমালোচনা

সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু দিল্লিতে বলেন, বাংলাদেশের প্রতি চীনের মনোভাব বিপর্যয়কর ও বেদনাদায়ক। অতীতে চীন সর্বত্রই জনগণের সংগ্রামকে সমর্থন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা অত্যাচারীর পক্ষ নিয়েছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী এই দিন সোনামুড়া নামে ভারতের উত্তর-পূর্বে একটি সীমান্তবর্তী গ্রামে গোলাবর্ষণ করলে তিন ব্যক্তি নিহত এবং কয়েকজন আহত হন।

এ ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী আসামের সীমান্ত গ্রাম লাতুর ওপরও মর্টারের গোলাবর্ষণ করে। এতে তিনজন নারীসহ আটজন আহত হন। বেশ কিছু বাড়িঘর ধ্বংস হয়।

অবরুদ্ধ দেশে মুক্তির অভিযান

মৌলভীবাজার জেলায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল ছোটলেখা চা-বাগানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে। দুই পক্ষে তুমুল সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন গুরুতর আহত হন।

সুনামগঞ্জের বিরামপুরে মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

শেরপুর জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নালিতাবাড়ী থানার তন্তর ও মায়াঘাসিতে পাকিস্তানি সেনাদের একটি টহল দলকে আক্রমণ করে। সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক মেজবাহ উদ্দিন গুরুতর আহত হন।

বৃহত্তর চট্টগ্রামে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর হেঁয়াকু ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যান।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, চার, পাঁচ ও এগারো; ইত্তেফাক, ২৮ ও ২৯ জুলাই ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২৮ ও ২৯ জুলাই ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান